গতিময় পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের নব সংযোজন চ্যাটজিপিটি বা জেনারেটিভ প্রি- ট্রেইন্ড ট্রান্সফরমার । সানফ্রান্সিসকো ভিত্তিক কৃত্রিম প্রযুক্তি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওপেন আইয়ের সাড়া ফেলে দেয়া চ্যাটবট হলো চ্যাটজিপিটি। এটি একটি ডাটাবেইজ প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা পরিচালিত চ্যাটবট। ইউজারের প্রত্যাশিত উত্তরের জন্য প্রচুর ডাটা সংরক্ষিত রয়েছে এতে। পৃথিবীর বহুল ব্যবহৃত সার্চ ইঞ্জিন বা মেশিন লার্নিং টুল গুগলের চিত্র ও লিংকভিত্তিক উত্তরের পরিবর্তে এটি টেক্সট ভিত্তিক উত্তর দেয়। ফলে এটি গতি এনেছে গবেষণাপত্র তৈরি, নিবন্ধ রচনা, গবেষণা পত্রের সাহিত্য পর্যালোচনা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে।
আমরা এখানে গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটির সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করতে পারি। নভেম্বর ২০২২-এ চ্যাটজিপিটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহারকারী প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আত্মপ্রকাশের প্রথম সপ্তাহেই এটি টেক দুনিয়ায় ঝড় তুলে গুগল, টুইটার, মেটার রেকর্ড ভেঙ্গে এক মিলিয়ন ব্যবহারকারী পেয়ে যায়। ফলে সারা বিশ্ব নড়েচড়ে বসে এবং শুরু হয় চ্যাটজিপিটির খুঁটিনাটি নিয়ে অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ। ২০১৫ এর দিকে টেক দুনিয়ার সেনসেশন ইলন মাস্ক ও স্যাম অল্টম্যান চ্যাটজিপিটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা শুরু করলেও পরবর্তীতে ইলন মাস্ক সরে যান। বর্তমানে তিনি সহ, গুগল, মেটা প্রভৃতি কোম্পানি একই ধরণের প্রযুক্তি বাজারে ছাড়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। যেমন, গুগল বার্ড নামের একটি চ্যাটবট বাজারে এনেছে। টেক্সট ভিত্তিক প্রোগ্রাম হওয়ায় চ্যাটজিপিটি গবেষণা ও শিক্ষা খাতে অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। মূলত ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা ওয়েব পেইজ, বই, উইকি, আর্টিকেল ইত্যাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ফিল্টারিং পদ্ধতি অবলম্বন করে চ্যাটবটে জুড়ে দেয়া হয়েছে। যে কারণে এটি বিপুল শব্দ ভা্লার, বাক্যের বিন্যাস, তথ্যের কোষাগার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে স্কুল- কলেজের ছাত্রদের হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্টের প্রয়োজনীয় তথ্যের সহজলভ্যতা যেমন রয়েছে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য বহুমাত্রিক তথ্য প্রাপ্তির নতুন ঠিকানা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে এটি আফ্রো-এশিয়াসহ বিশ্বের সব অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাভাষীদের মধ্যে অনগ্রসর ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশু- কিশোরদের পাঠদানে সহযোগিতার জন্য আরো ব্যাপকভাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা চলছে। মোটকথা, যে কোনো বিষয়ের তথ্য- উপাত্তের আরো বেশি ব্যাপ্তি ও সহজলভ্যতা নিশ্চিতের জন্য প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। গবেষণায় অংশীদারীত্বের অংশ হিসেবে মাইক্রোসফট চুক্তি করেছে ওপেন আইয়ের সাথে। যা পরবর্তীতে কথোপকথনমূলক উপায়ে চাটিং বা যোগাযোগ সক্ষমতাকে আরো সম্ভাবনাময় করে তুলবে। গবেষকরা তাদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য তথ্য- উপাত্ত অনুসন্ধান- বিশ্লেষণের সুযোগ পাবে। এছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞান, কৃষি প্রযুক্তি, প্রোগ্রামিং ভাষা, কোডিং, অ্যানালিটিকাল অ্যাবিলিটি, ক্রিটিকাল রিসোনিং এমনকি গান, কবিতা, গল্প সম্পর্কে তথ্য দিয়ে ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সহযোগিতা করবে চ্যাটজিপিটি।
বিশেষভাবে গবেষকদের চ্যাটজিপির প্রতি আগ্রহের অন্যতম কারণ গবেষণার মানোন্নয়ন ও নিবন্ধ লিখতে ভাষাগত উৎকর্ষতা সাধন। ধারণা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে এটি গবেষণা ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করবে এবং পরীক্ষামূলক তথ্য- উপাত্ত উপস্থাপন করবে। এমনকি চ্যাটজিপিটি একজন প্রকৃত সম্পাদক (Author) এবং সম্পাদনা বোর্ড ( Peer Reviewer) হিসেবে কাজ করবে।
শিক্ষা-গবেষণা ক্ষেত্রে এই উন্নতি- আধুনিকায়নের সাথে কিছু উদ্বেগও রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ থেকে বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এর বিরোধিতা করে আসছে। তারা মনে করেন, এটি দ্রুত ও বহুলাংশে সঠিক উত্তর দেয় বলে শিশু- কিশোর এমনকি বয়:প্রাপ্তদেরও সৃজনশীল চিন্তা- ভাবনা লোপ পেতে পারে। পড়াশোনা বা গবেষণা কাজে মনোযোগ কমে গিয়ে চৌর্যবৃত্তি (Plagiarism) এর দিকে ঝোঁক বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও ব্লগার, ফ্রিল্যান্সারা কর্মহীন হবে এবং হুমকির মুখে পড়বে প্রতিষ্ঠিত তথ্য ভা্লার উইকিপিডিয়া (Wikipedia)। পেশাজীবীদের কাজ কমে গিয়ে রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে ম্যানুয়াল লেবার কমে গিয়ে অধিক মানুষের আয়ের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়ে অল্প সংখ্যক লাভবান হওয়ার মতো পরিস্থিতি হতে পারে। তাছাড়া চ্যাটজিপিটির কিছু প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, লেটেস্ট তথ্য হালনাগাদ বা ইনপুট করা না হলে যথাযথ উত্তর দিতে পারবে না। উন্মুক্ত মাধ্যম হওয়ায় তথ্য- উপাত্তের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গ্রহণযোগ্যতার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। কেননা, এসব উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি চমকপ্রদ তথ্য- উপাত্ত উপস্থাপন করলেও সর্বদাই যে তা সঠিক হবে সে নিশ্চয়তা তো নাই। যেমন, গুগল ম্যাপ আবিস্কারের পরে গুগল স্ট্রিট দেখে দেখে গাড়ি চালাতে চালাতে খাদে পড়ার মতো ঘটনাও বিশ্বে ঘটেছে। এছাড়া স্পামিং, সাইবার আক্রমণ, হ্যাকিং, তথ্যচুরি করে অর্থ আদায় এবং প্রতারণামূলক যেকোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনাই ঘটতে পারে। এতদসত্ত্বেও প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে এটির অসাড়তা ও অসুবিধাকে বড় করে না দেখে এটিকে কিভাবে আরো বেশি মডিফাই করে এর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে সেবা ও উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যায় সে দিকে নজর দেয়াই শ্রেয়। প্রতিটি প্রযুক্তিই যেমন, কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট, রোবট ইত্যাদি কিছু সুবিধা- অসুবিধা নিয়েই আবির্ভূত হয়। সুতরাং এটি পুরোপুরি নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উপর।
সর্বোপরি, প্রতিনিয়ত প্রযুক্তি আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার ধারণাকে পালটে দিয়ে হালনাগাদরূপে হাজির হচ্ছে। সুতরাং মানব কল্যাণে সুস্থ ধারার সমাজ ও সংস্কৃতি এবং উন্নত ও মার্জিত সভ্যতা গড়ে তুলতে প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে আমাদের আরো বেশি সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : প্রভাষক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর