মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইনের কাহিনি আমাদের সকলেরই জানা। উহা কল্পকাহিনি হইলেও বাস্তব কখনো-সখনো কল্পকাহিনিকেও ছাড়াইয়া যায়। ‘ক্ষমতা জার্সি গায়ে বেপরোয়া বাহিনী’ শিরোনামে পত্রিকান্তরে গত মঙ্গলবার সংবাদটি আমাদের মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইনের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। একজন কাউন্সিলর কীভাবে অপকর্মে জড়াইয়া দলের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করিতে পারেন—সংবাদের ছত্রে ছত্রে রহিয়াছে তাহার বিবরণ। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হইল, সেই কাউন্সিলর আবার দলে অনুপ্রবেশকারী হিসাবে অভিযুক্ত। অভিযোগ রহিয়াছে যে, অতীতে তিনি ছাত্রদল করিতেন, বর্তমানে নৌকায় চাপিয়া অপকর্মের ভান্ডার খুলিয়া বসিয়াছেন। এই সকল অপকর্ম যদি পোড় খাওয়া পুরাতন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ কর্মীরা করিত—তাহা হইলেও দলের পুরাতন কর্মীদের মনে সান্ত্বনা থাকিত; কিন্তু যাহারা অপকর্ম করিতেছে, ক্ষমতার অন্দরে ঢুকিয়া চারিদিকে ছড়ি ঘুরাইতেছে, তাহারা ক্ষমতাসীন দলে এক কথায় ‘অনুপ্রবেশকারী’।
লক্ষণীয় যে, সাধারণ নির্বাচন যতই ঘনাইয়া আসিতেছে ততই এই সকল অনুপ্রবেশকারীর অপকর্মের ‘বহর’ বাড়িতেছে, ক্ষুণ্ন করিতেছে দলের ভাবমূর্তি। এই চিত্র সমগ্র দেশেরই। দেশের যে কোনো একটি জেলার হিসাব লইলেই এই সত্য স্পষ্ট হইবে। দেখা যাইবে, সর্বত্রই নব্য রাজাকার-আলবদর মতাদর্শের অনুপ্রবেশকারীদের দৌরাত্ম্য। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একসময় বিরুদ্ধাচরণকারীরা এখন যেইভাবে দলটিতে ঢুকিয়া পড়িয়াছে এবং ক্রমান্বয়ে ঢুকিয়া পড়িতেছে তাহাতে দিনে দিনে এই দলের প্রকৃত কর্মীরা আরো কোণঠাসা হইয়া পড়িতেছে। রাজনৈতিক দলের মতোই প্রশাসনের চিত্রও একই রকম। সেইখানেও চতুরতার সহিত নিজেদের পরিচয়কে ঢাকিয়া রাখিয়া আসন গাড়িয়া বসিতেছে স্বাধীনতা ও আওয়ামীবিরোধী চিন্তাধারার ব্যক্তিবর্গ। এই সকল স্বাধীনতাবিরোধী প্রশাসন ও রাজনীতির ময়দানে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম ভাঙাইয়া হেন অপরাধ নাই যাহা করিতেছে না!
দার্শনিক প্লেটো বলিয়াছিলেন—‘সেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কষ্টদায়ক, যেই রাজনীতি নিম্নশ্রেণির মানুষের হাতে চলিয়া যায়।’ নব্য রাজাকার-আলবদরদের এই অর্থে নিম্নশ্রেণির বলা যায় যে, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তাহাদের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক, স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ। অথচ স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগে তাহাদের অবাধ প্রবেশ যেন ডালভাত হইয়া গিয়াছে। দুঃখজনকভাবে আমরা এমনও দেখিতে পাই যে, আওয়ামী লীগের নেতৃবর্গের কেহ অনুপ্রবেশকারী সম্পর্কে মঞ্চে দাঁড়াইয়া জাতিকে সচেতন করিতেছেন, অথচ তাহার পাশেই অনুপ্রবেশকারী দাঁড়াইয়া হাতে তালি দিয়া চলিয়াছেন! সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ! কীভাবে তাহারা প্রবেশ করিতেছে, কীভাবে তাহারা পদ-পদবি পাইতেছে, তাহা দলেরই শীর্ষ নেতাদের জানিবার কথা সবচাইতে অধিক; কিন্তু প্রশ্ন হইল, এই স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর এবং তাহাদের পরবর্তী প্রজন্মের এহেন ‘ক্ষমতায়ন’-এর ফলে দলের রাজনীতি ভয়ংকরভাবে কলুষিত হইতেছে। দেশের আদর্শিক রাজনীতি যে ভেজালযুক্ত হইয়া পড়িতেছে, তাহার দায় এবং পরিণাম ক্ষমতাসীন দলকেই সর্বাধিক ভোগ করিতে হইবে—ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কারণ এই অনুপ্রবেশকারীরা এক কথায়—ফ্রাংকেনস্টাইন। এই পরিস্থিতি হইতে উত্তরণের উপায় কী, তাহা আমাদের জানা নাই। তাহার কারণ, বেড়ায় যদি খেত খাইয়া ফালায় তাহা হইলে করণীয় আর কিছু থাকে না! এই সকল অন্যায়, অনিয়মের সকল দায়ভার গিয়া বর্তায় যিনি প্রধান নির্বাহী থাকেন, তাহার উপর।
এখন এই অশুভ শক্তি তথা অনুপ্রবেশকারীরা প্রভাব-প্রতাপশালী হইয়া উঠিতেছে বিধায় প্রশাসন ও দলে সত্, নিষ্ঠাবান ও আদর্শে বিশ্বাসী কর্মকর্তা ও নেতারা হতাশ হইয়া পড়িতেছেন। তাহারা হাল ছাড়িয়া দিতেছেন। কারণ চোখের সম্মুখেই তাহারা স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্ফাালন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে দেখিতেছেন এবং নিজেদের দেখিতেছেন ক্রমশ গুরুত্বহীন হইতে। এমনিতেই পৃথিবী যেই দিকে যাইতেছে, তাহাতে অর্থনীতি ও সার্বিক পরিস্থিতি কোন গহ্বরে লইয়া যাইবে—কেহ বলিতে পারিতেছে না। ইহার সহিত সামনে ঘনাইয়া আসিতেছে জাতীয় নির্বাচন। সুতরাং ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য ষড়যন্ত্র করিবার মোক্ষম সময় এখন। ক্ষমতার পালাবদল হইলেই এই অনুপ্রবেশকারীরা যেইভাবে ঢুকিয়া পড়িয়াছে, ঠিক সেইভাবেই সন্তর্পণে উধাও হইয়া যাইবে নিঃসন্দেহে। সুতরাং সময় থাকিতে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প কিছু নাই। মনে রাখিতে হইবে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।