শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অগ্নিঝরা সেই দিনগুলো

আপডেট : ২৫ মার্চ ২০২৩, ০৫:০০

১৯৭১ সাল। আমি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র। চারিদিকে একটা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। এরই মধ্যে চলে এলো ৭ মার্চ। আমাদের কাছে খবর এলো, স্বাধীনতার মহান স্থপতি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দেবেন। সেখানে আমরা উপস্থিত হলাম।

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায়। সেদিন ভাষণ দেওয়ার জন্য মঞ্চে উঠলেন তিনি, সামনে দেখলেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্তাল জনতা; তিনি জোরালো কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই দিনের অগ্নিঝরা ভাষণে তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’

যার ভাষণে পুরো জাতি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিলেন।

এরপর আসে বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ। ইতিহাসের কালরাত। ২৫ মার্চের জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর গোপন পরিকল্পনা তৈরি করে।

২৫ মার্চের আক্রমণে বাঙালি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ মানুষসহ লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত সেই হামলায় মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে সমগ্র ঢাকা শহর।

এপ্রিল মাসে আমি ঢাকা কলেজ থেকে চলে গেলাম আমার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের কাঁচেরকোল গ্রামে। সেখানে গিয়ে চিন্তা করছিলাম কী করব। সেখানে আমার এক বন্ধু ছিল, যার নাম জুলফিকার হায়দার। আমার বাবা ছিলেন কলকাতায় খ্যাত আলহাজ ড. হাবিবুর রহমান এবং আমরা চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমাদের সবার চিন্তাধারা একই ছিল। আমার দুই ভাই ডক্টর ছিলেন। আমার বড় ভাই ডক্টর রেজাউর রহমান, তিনি কলকাতায় একটি রিফিউজি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। আমার সেজ ভাই রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান, তিনি তখন জেনেভায় রিফিউজি। তিনি ফরেন সার্ভিসের চাকরি ছেড়েছেন পাকিস্তানে। তাকে আমি খবর দিলাম। পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি চলে গেলাম কাঁচেরকোল থেকে ৬০ মাইল দূরে ভারতের শিকারপুরে। সেখান থেকে প্লেনে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো দেরাদুন ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে মুজিববাহিনীর সঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। আমাদের দলনেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এবং প্রশিক্ষণ শিক্ষক ছিলেন ভারতের মেজর মালহোত্রা রায়। তাদের কাছে যুদ্ধের ট্রেনিং শেষে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের বাড়িতে যেতাম না। এক অত্মীয়ের বাড়িতে থাকতাম। দিনে আমরা প্ল্যান করতাম আর রাতে বিভিন্ন অপারেশনে যেতাম—কীভাবে, কোন জায়গায় পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার আলবদরদের হত্যা করা যায়।

তাছাড়া যুদ্ধের শুরুতেই ৩০ মার্চ রাত ও ৩১ মার্চ দিনে ঝিনাইদহের গাড়াগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির বিজয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিজয়ের মাইলফলক হয়ে আছে।

আমি ঢাকা থেকে শুনেছিলাম কীভাবে গাড়াগঞ্জের ব্রিজকে উড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। শৈলকুপার গাড়াগঞ্জে কুমার নদের ওপর নির্মিত ব্রিজ। এই ব্রিজ পার হতে না পারলে যশোর-খুলনায় যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই পাকিস্তানি সেনাদের এই দিকে আসতে হলে এটা পার হয়ে আসতে হতো। যশোর থেকে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা—এদিকে যেতে হলে এই ব্রিজ ছাড়া পারত না। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল।

কাঁচেরকোলের পাশে ছিল ডাকুয়া নদী। সেখানেও রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। অনেক পাকিস্তানি সেনা মারা গেছে।

শৈলকুপা সদর উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি ছিল। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের উপজেলাকে পাকিস্তানি সেনামুক্ত রেখেছি।

যখন আমাদের বিজয় নিশ্চিত হচ্ছিল, সেই সময় নভেম্বর মাসের দিকে রাজাকারের সঙ্গে পাকিস্তানি দস্যুরা আমাদের বাড়িতে এসে হামলা করে। আমাকে খুঁজতে আসে, পরিবারের সবার কাছে আমার কথা জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু পরিবারের কাউকে কোনো ক্ষতি করে না, আমার খোঁজ না পেয়ে তারা আমাদের ঘরে লুটপাট করে স্বর্ণের গহনা, শত বছরের সিলভারের কারুকাজ করা দামি যত জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়।

যুদ্ধ করতে গিয়ে না ছিল আমাদের জীবনের মায়া, না ছিল পরিবারের চিন্তা। তখন আমাদের একটাই চিন্তা ছিল, কীভাবে দেশকে শত্রুমুক্ত করব এবং স্বাধীনতা আনব। অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হয়েছে। সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা মনে করি। অনেক কিছুই ঠিকমতো মনে করতে পারছি না, তার পরেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সময়কার লোমহর্ষক কিছু দৃশ্য, যা মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। সেই সব কথা আর মনে করতে চাই না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, সুদূর লন্ডনের প্রবাসী হয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে দেশের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি, জানি না কতটুকু করতে পেরেছি।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন