আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচাইতে গৌরবময় দিন। এই দিনে বাঙালি জাতি তাহাদের চিরকালীন দাসত্ব ঘুচাইয়া স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হইয়াছিল এবং লাখো প্রাণের বিনিময়ে ছিনাইয়া আনিয়াছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী ৩০ লক্ষ শহিদ, স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতির সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সার্বিকভাবে সহায়তাকারী বন্ধুরাষ্ট্র ও বিদেশি নাগরিকদের।
আমাদের স্বাধীনতার প্রথম লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলামুক্তি; কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন কি বহুলাংশে পূরণ হইয়াছে? আমরা হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া বিদেশি শোষণ-শাসন ও শৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিলাম। একসময় বারো ভুঁইয়ারা আমাদের মনে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগাইয়া তুলেন; কিন্তু তাহারা একেক জন ক্ষুদ্র অঞ্চলের শাসক ছিলেন বলিয়া ছিল নানা সীমাবদ্ধতা। অতঃপর ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বারংবার সংগ্রাম ও বাঙালির রেনেসাঁ আন্দোলনের সূত্র ধরিয়া আমাদের মধ্যে বৃহত্তরভাবে স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বপিত হয়। আমরা বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করি। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের লক্ষ্যই ছিল একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেইখানে দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হইবে; কিন্তু ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হইলেও এই সকল অধিকার রক্ষায় আমরা এখনো বহু পিছনে পড়িয়া রহিয়াছি।
ইহা সত্য যে, স্বাধীনতার পাঁচ দশকে খাদ্য উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অনেক ক্ষেত্রে দেশ আগাইয়া গিয়াছে। আর্থসামাজিক কাঠামো ও যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হইয়াছে। গেঞ্জি পরা বাঙালি এখন শার্ট পরিতেছে; কিন্তু পাকিস্তানি আমলে আমাদের রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মূল কথা ছিল যে বৈষম্যের অবসান, তাহা আজও দূর হয় নাই। কেহ কেহ আজ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলিয়া বটগাছ হইয়া উঠিয়াছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখনো বসবাস করিতেছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। সরকারি সম্পদ লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচারসহ যে সকল অনাচার চলিতেছে তাহা কোনোভাবেই স্বাধীনতার চেতনার সহিত সংগতিপূর্ণ নহে। সুসংহত গণতন্ত্র, কার্যকরী নির্বাচনব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার হস্তান্তর, বাক্স্বাধীনতা, আইনের শাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি ব্যতীত স্বাধীনতা অর্থবহ হইতে পারে না।
বিশ্বে যুদ্ধবিগ্রহের মতো এক কঠিন বাস্তবতায় এবং ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের এক কঠিন মুহূর্তে আমাদের দলমত নির্বিশেষে সকলকে মহান স্বাধীনতা সমুন্নত রাখিবার ব্যাপারে দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করিতে হইবে। এই জন্য জাতীয় স্বার্থে বিবাদবিসংবাদ যতটা সম্ভব ভুলিয়া যাইতে হইবে। এই মুহূর্তে দেশে সবচাইতে অধিক দরকার ইউনিটি বা একতা। একজন জাতীয় নেতার প্রধান কাজ হইল দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখা; কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে আমরা ইহার ব্যতিক্রম দেখিতে পাই। জাতিকে খণ্ডবিখণ্ড করিবার অপপ্রচেষ্টা চলে নানাভাবে। স্বাধীনতার পক্ষবিপক্ষ বলিয়াও তৈরি করা হয় বিভাজনের রেখা। কী ভয়াবহ কথা! কনফ্লিক্ট রেজুলেশনের কোনো চিন্তাভাবনাই নাই। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ একদা ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের কলোনি ছিল। এখন এই সকল দেশ স্বাধীন হইলেও নিজেদের মধ্যে অনৈক্য ও মারামারির কারণে নাগরিকরা শান্তিতে ঘুমাইতে পারিতেছেন না। নাগরিকদের ঘুম হারাম হইয়া যায় এমন পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি ও বজায় রাখা স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী নিঃসন্দেহে।
উল্লেখ্য, ১২১৫ সালের ১৫ জুন ব্রিটেনে স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক ম্যাগনাকার্টা দলিল। এই চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল, রাজার প্রতিনিধি স্থানীয় লোকদের অনুমোদন ছাড়া কাহারো স্বাধীনতায় বা সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না। এই দলিল পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহুদেশে মানবাধিকার ও জনগণের ক্ষমতায়নে পালন করে পথনির্দেশকের ভূমিকা; কিন্তু আজ আমরা স্বৈরাচারের নামে বিভিন্ন দেশে রাজাদের মতোই এমন শাসকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি লক্ষ করিতেছি যাহারা নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত করিতেছেন। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হইল এই নাগরিক স্বাধীনতা। মতপ্রকাশ, সভা-সমাবেশ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ইত্যাদির অধিকার রক্ষাসহ মানুষের স্বাধীন সত্তার স্বীকৃতি অবশ্যই দিতে হইবে। অতএব, ঐক্য ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষাই হউক আমাদের এবারের স্বাধীনতা দিবসের মূল অঙ্গীকার। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে সবাইকে জানাই অনাবিল প্রীতি ও শুভেচ্ছা।