ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাটের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে দেখা যাইতেছে, ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশি নাগরিকদের সংখ্যা বাড়িতেছে। গত দুই বৎসরে ৫০ হাজার ৭৯০ জন বাংলাদেশি ইউরোপে গিয়া রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করিয়াছেন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৮২৫ জন। পরবর্তী বৎসর তাহা বাড়িয়া দাঁড়াইয়াছে ৩১ হাজার ৯৬৫ জনে। ফলে ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার দিক হইতে বাংলাদেশ এখন সপ্তম স্থানে উঠিয়া আসিয়াছে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাছিয়া লওয়া হইতেছে ইতালি ও ফ্রান্সকে। এই দুইটি দেশের বাহিরে রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া, মালটা ও স্লোভাকিয়ায় বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন বাড়িতেছে। তবে শুধু বাংলাদেশিরাই ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছেন, এমন নহে। আসলে গত বৎসর ২০২২ সালে সমগ্র বিশ্ব হইতে ইউরোপে গিয়া রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা বাড়িয়াছে ৬৪ শতাংশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত প্রভৃতি দেশের নাগরিকগণ এই মহাদেশটিতে বৈধ-অবৈধ পথে অভিবাসনের জন্য ভিড় জমাইতেছেন।
ইউরোপে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশিদের সংখ্যা কেন বাড়িতেছে তাহা একটি বড় প্রশ্ন। এই প্রশ্ন এই জন্য তোলা হইতেছে যে, এই সংখ্যা বাড়িতেই থাকিলে তাহার নেতিবাচক প্রভাব পড়িতে পারে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর। আমরা জানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন অসংখ্য বিদেশি নাগরিক। তাহারা অভিবাসী, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বা বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশকারী। ইউরোপের সমস্যা হইল, এই মহাদেশটি শীতপ্রধান অঞ্চল হওয়ায় সেইখানে জন্মহার বরাবরই কম। তদুপরি সেখানে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়ায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা আরো নিম্নগামী। ফলে অর্থনৈতিক প্রাণচঞ্চলতার জন্যই এই সকল দেশে অভিবাসী প্রয়োজন। এই সকল দেশ গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাদি দর্শনে বিশ্বাসী। এমনকি কোনো ফাঁসির আসামিও যদি কোনোভাবে সেই সকল দেশে গিয়া রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করিতে পারে, তাহা হইলে তাহাদের ফেরত প্রদানের কোনো নিয়ম নাই। ইউরোপের এই অভিবাসন নীতিরই সুযোগ লইতেছে বিভিন্ন দেশের মানুষ। যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা চরম দারিদ্র্যের কারণে যাহারা শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছে, মানবিক কারণে তাহারাও লাভ করিতেছে সহানুভূতি। সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তাসহ নানা কারণে ইউরোপ আজ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিকট স্বর্গরাজ্য। এই জন্য ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়া জীবনের ঝুঁকি লইয়া হইলেও সেইখানে যাইতে অনেকে পিছপা হন না; কিন্তু ইহাতে অভিবাসীদের ভারে ক্রমেই নুব্জ হইয়া পড়িতেছে ইউরোপের দেশসমূহ। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর চাপ সেইখানে ক্রমবর্ধমান। এই জন্য স্থানীয় নাগরিকদের মধ্যে বাড়িতেছে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়া প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার অভিবাসী ইউরোপে আসিয়াছে ২০২২ সালে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণেও তাহারা এখন ইহা হইতে মুক্তি পাইতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেছে। গত জানুয়ারি মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী ইউরোপিয়ান কমিশন সেনেগাল, ইরাক ও বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীদের প্রত্যাবাসনে একই পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করিয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপের সহিত সুসম্পর্ক রক্ষায় সেই সকল দেশে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী ও রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে আমাদের এখন হইতে সতর্কমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে হইবে।
বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগের অভাবে কর্মসংস্থান বাড়িতেছে না। এই জন্য কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে ইউরোপে পাড়ি দিতেছেন। আবার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ইত্যাদি কারণে সেই সকল দেশে অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করিতেছেন। এখন তাহাদের অনেককে ফিরাইয়া আনিবার জন্য চাপ ক্রমাগতভাবে বাড়িতেছে। এই সকল দেশে বাংলাদেশিদের ভিসা সীমিত করিবার কথা বলা হইতেছে। এই অবস্থায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূরীকরণের উপর আমাদের অধিক জোর দিতে হইবে। কেননা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকিলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অভাব হইবে না এবং দেশেই পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকিলে কেহ জীবনের ঝুঁকি লইয়া বিদেশে যাইতে চাহিবেন না। যাহাতে কেহ অবৈধভাবে ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশসমূহে যাইতে না পারেন, সেই দিকে পুলিশ ও প্রশাসনকে তৎপর থাকিতে হইবে। সাধারণত আমাদের নাগরিকগণ ঢাকা হইতে দুবাই হইয়া লিবিয়ার মাধ্যমে কিংবা তুরস্ক হইয়া সরাসরি ইউরোপে যান। এই সকল পথে বাড়াইতে হইবে নজরদারি।