সোমবার, ০৫ জুন ২০২৩, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কথা কম বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ

আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৩, ০০:২৫

ভার্চুয়াল মিডিয়ার মধ্যে একধরনের মাদকতা রহিয়াছে। বিশেষ করিয়া ফেসবুক, টুইটার জাতীয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই মাধ্যমের জনপ্রিয়তা এত বেশি বৃদ্ধি পাইতেছে যে, একজন মানুষের হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট থাকিলে যখনই সময় বা সুযোগ পান, ফেসবুকে একবার ঢুঁ মারিয়া আসেন। নূতন বাহির হইয়াছে ‘রিল’ নামক ছোট ভিডিও। সেইখানে নিজেকে ভাইরাল করিতে যাহা নহে, তাহাই করিতেছে কিছু কিছু কনটেন্ট নির্মাতা। স্মার্টফোনের ক্যামেরার মাধ্যমে এখন সকলেই কনটেন্ট ক্রিয়েটর। ভাচুর্য়াল জগতের এই বিপ্লবের নিশ্চয়ই ভালো দিক রহিয়াছে অনেক। খারাপ দিকটি হইল—অবোধ বাচ্চাদের হাতে দিয়াশলাইয়ের বাক্স তুলিয়া দিলে যাহা হইবার আশঙ্কা থাকে, ফেসবুকেও তেমনি যখন-তখন দাবানল লাগিতে দেখা যায়। কী করিয়া ফেসবুক ব্যবহার করিতে, কী এইখানে লেখা উচিত বা উচিত নহে—এই ব্যাপারে স্কুলিং নাই প্রায় কাহারোই। প্রত্যেকেই নিজস্ব সিভিক সেন্স দিয়া ফেসবুক চালান। সকলের সিভিক সেন্স উন্নত নহে, ফলে ফেসবুকের বুকে ঝগড়া-ফ্যাসাদ-জটিলতাও চলিতেই থাকে। সেই যে অনেক পূর্বে কবি শঙ্খ ঘোষ বলিয়াছিলেন—‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, ফেসবুকেও তেমনি প্রত্যেকেই নিজস্ব আরশীতে নিজের বিজ্ঞাপন করেন, ভাইরাল হতে চান, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ, জ্ঞানী এবং প্রভাবশালী কিংবা প্রভাবশালীর সঙ্গে সুসম্পর্ককারী ব্যক্তি হিসেবে দেখাতে চান।’ 

ইহা যেন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। মানুষের এই প্রতিযোগিতায় লাভবান হইতেছে ফেসবুকের কোম্পানি—মেটা। ফেসবুক যে ইহার ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করিয়া থাকে, ইহা লইয়াই অনেকবার প্রশ্ন উঠিয়াছে। একাধিকবার জরিমানা গুনিয়াছে ফেসবুক। গত বৎসর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অপরাধে করা মামলায় হারিয়া গিয়া সাড়ে ৩ কোটি ৭০ লক্ষ ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হইয়াছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা-কে। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রান্সিসকোর ফেডারেল আদালত সেই সময় জানাইয়াছে, অযাচিতভাবে ব্যবহারকারীর অবস্থান বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিকে জানাইয়া দেওয়ার মাধ্যমে ফেসবুক মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার আইন ভঙ্গ করিয়াছে। ফেসবুকের সবচাইতে বড় সমস্যা হইল ফেকনিউজের দৌরাত্ম্য। ইহাতে এত বেশি ফেক নিউজ থাকে যে, অনেকেই ইহাকে ‘ফেসবুক’ না বলিয়া ‘ফেকবুক’ বলিতে চাহেন। ফেসবুকের অতি সামান্য ভাসমান জ্ঞানই অনেকের জ্ঞান আহরণের প্রধান ক্ষেত্র, ফেসবুকের ফেক নিউজের বেসাতিই অনেকের নিকট প্রধান সংবাদসূত্র! এমতাবস্থায় যাহা হইবার তাহাই হইতেছে। তথ্যের বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলার এক ভয়ানক অরাজকতা দেখা যাইতেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিতে। 

প্রথম কথা হইল—ফেসবুকে ফেকের অভাব নাই। দ্বিতীয়ত, উহাতে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার বালাই নাই। সুতরাং সহজ প্রশ্ন হইল—মানুষ ফেসবুক কেন ব্যবহার করিবে? এই ক্ষেত্রে এককথায় বলা যায়, ফেসবুকেরও রহিয়াছে অসংখ্য ইতিবাচক দিক। ইহাতে তুলনা টানা যায় ঔষধের সহিত। প্রায় প্রতিটি ঔষধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রহিয়াছে, কিন্তু ঐ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তুলনায় লাভের পাল্লা অনেক বেশি ভারী থাকে বিধায় শরীর খারাপ করিলে সংশ্লিষ্ট ঔষধের ওপর আমাদের নির্ভর করিতে হয় বটে। কিন্তু সমস্যা হইল—ফেসবুক ব্যবহারকারী প্রায় সকলেই ‘বিশ্বাস’ করিয়া ফেসবুকে তাহাদের ‘মনের ভান্ডার’ খুলিয়া দিয়া থাকেন। কিন্তু ইহা লইয়া কেহ মাথা ঘামায় না যে, ফেসবুক সেই সকল তথ্য লইয়া ব্যবসা করিতে পারে। বাংলায় একটি প্রবাদ রহিয়াছে—শিয়ালের নিকট মুরগি বর্গা দেওয়া। ফেসবুকের নিকট ব্যক্তিগত তথ্য বর্গা দেওয়ার সহিত ঐ প্রবাদের খুব বেশি পার্থক্য নাই। মুশকিল হইল, মানুষের তথ্যের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দেয় ফেসবুক। অর্থাৎ শিয়াল হইয়া সে এই ঘোষণা দেয় যে, তাহার নিকট ব্যক্তিগত-তথ্য নামের মুরগিখানি নিরাপদে রাখা যাইবে। কিন্তু শেষাবধি সেই শর্ত ফেসবুক গোপনে বরখেলাপ করে। সুতরাং সাধারণ মানুষকেও বুঝিতে হইবে, কেবল ফেসবুক নহে, ইন্টারনেটের জগতে প্রদান করা কোনো তথ্যই গোপন থাকে না শেষাবধি। কতটুকু তথ্য প্রকাশযোগ্য—তাহা বুঝিয়া লইতে হইবে সাধারণ ব্যবহারকারীকেই। কথা যত কম বলা যায়, ততই বুদ্ধিমানের কাজ।

 

ইত্তেফাক/ইআ