মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ প্রসঙ্গে

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ০৪:৩০

গত বুধবার পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ সালের ফলাফল তুলিয়া ধরা হইয়াছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এই জরিপে দেখা যাইতেছে—দেশে বেকারের সংখ্যা গত পাঁচ বত্সরের তুলনায় কমিয়াছে। এই পরিসংখ্যানে অনেকে বিস্মিত হইতে পারেন; কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলে এবং  আইএলও তথা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মানদণ্ড বিবেচনায় নিলে বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। যদিও ইহা লইয়া কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ দ্বিমত পোষণ করিয়াছেন। জরিপের ফলাফলে দেখা যাইতেছে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা ২৬ লক্ষ ৩০ হাজার। শতাংশের হিসাবে এখন ৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ বেকার। ইহার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১৬ লক্ষ ৯০ হাজার এবং নারীর সংখ্যা ৯ লক্ষ ৪০ হাজার। ইহার তুলনায় ২০১৭ সালে আমাদের দেশে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লক্ষ। শতকরা হিসাবে যাহা ৪ দশমিক ২ শতাংশ। ইহাতে দেখা যায়, পাঁচ বত্সরের ব্যবধানে সার্বিক বেকার কমিয়াছে ৭০ হাজার।

এখন প্রশ্ন হইল, করোনা মহামারির রেশ ও ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে যখন বিশ্ব অর্থনীতির ত্রাহি অবস্থা বিরাজমান, তখন বেকারত্ব দূরীকরণে এই সাফল্য আমাদের কীভাবে অর্জিত হইল? ইহারও সুন্দর জওয়াব রহিয়াছে। বলা হইতেছে, এই দুর্যোগকালীন আমাদের কর্মসংস্থান বাড়িয়াছে কৃষি খাতে, তবে কমিয়াছে শিল্পে। শিল্পে যে কমিয়াছে তাহা সুস্পষ্ট। কেননা জ্বালানি তৈলের মূল্যবৃদ্ধিসহ সার্বিকভাবে জ্বালানিসংকটে ধুঁকিতেছে আমাদের শিল্পকারখানাগুলি। ইহা লইয়া মালিকরা এখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্সুবিধার দাবি এখনো সুদূরপরাহত। উত্পাদন খরচ যেইভাবে বাড়িয়া চলিয়াছে দিনদিন, তাহাতে শ্রমিক ছাঁটাইসহ শ্রমিক অসন্তোষের কথাও আমাদের অজানা নহে; কিন্তু কৃষি খাতে কর্মসংস্থান বাড়িয়া যাইবার বিষয়টিও লক্ষণীয় ও ব্যাখ্যাযোগ্য। ইহাকে অনেকের নিকট অলৌকিক ব্যাপার বলিয়া মনে হইতে পারে। তবে ইহাকে আমরা দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রতিফলন বলিয়াই মনে করি। কেননা করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হইবার পর আমরা আমাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বারংবার সতর্ক করিয়া দিয়াছিলাম যে, বিশ্বমন্দার উদ্ভূত পরিস্থিতির অভিঘাত আমাদের দেশেও আসিয়া লাগিতে পারে। সৃষ্টি হইতে পারে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি। এই জন্য পূর্বে খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করিতে হইবে। ইহার পর আমরা দেখিলাম, সরকারপ্রধানের তরফ হইতে দেশের এক ইঞ্চি জমিনও পতিত না রাখিবার জন্য বারংবার নির্দেশনা আসিতে থাকিল। তিনি নিজেও গণভবনে ব্যক্তিগতভাবে চাষাবাদ বাড়াইয়া দিলেন যাহাতে দেশের মানুষ অনুপ্রাণিত হইতে পারে। আমরা মনে করি, কৃষি খাতে কর্মসংস্থান যে বাড়িয়াছে, তাহাতে এই অনুপ্রেরণা কাজে আসিয়াছে বইকি।

কৃষির পাশাপাশি সেবা খাতেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাইয়াছে। তবে এই বৃদ্ধির জন্য আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগিবার কোনো কারণ নাই। মূলত করোনা মহামারির সময় অনেক নাগরিক বিভিন্ন শহরাঞ্চল ছাড়িয়া গ্রামে চলিয়া যান। অনেকে চাকুরিচ্যুত হন। কেহ-বা আবার শহরাঞ্চলে থাকিয়া সংসারের ব্যয় নির্বাহ করিতে না পারায় গ্রামে চলিয়া যাইতে বাধ্য হন। সেখানে তাহারা নিরুপায় হইয়া কৃষিতে আত্মনিয়োগ করেন। শাকসবজি চাষসহ মত্স্য উত্পাদন, গৃহপালিত পশু পালন ইত্যাদি স্বনির্ভরশীল পেশায় নিযুক্ত হন। এই কারণেও কৃষিতে কর্মসংস্থান বাড়িতে পারে। তাহা ছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার গাইডলাইন হইল যাহারা এক সপ্তাহে অন্তত এক ঘণ্টা কাজে নিয়োজিত ছিলেন, তাহারা আর বেকার নন। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেকারের এই সংজ্ঞা লইয়াও প্রশ্ন রহিয়াছে। তাহার পরও এই কথা অনস্বীকার্য যে, করোনা ও যুদ্ধবিগ্রহের সময়ও আমরা যেইভাবে নাক জাগাইয়া এবং পুরাপুরি ডুবিয়া না গিয়া বাঁচিয়া রহিয়াছি, তাহা কম সার্থকতা নহে। ইহাতে সরকারের কৃতিত্ব রহিয়াছে নিঃসন্দেহে। তাহার পরও যখন কোনো চাকুরির ক্ষেত্রে হাজার হাজার, এমনকি লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর আবেদন জমা পড়ে, তখন দেশে বেকারের সংখ্যা যে কত তাহা সাধারণ জ্ঞান দিয়া বুঝিতে আমাদের অসুবিধা হয় না। অতএব, দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে। এই ব্যাপারে এখনই কার্যকর উদ্যোগ লওয়া দরকার। ইহার সহিত প্রায় ছয় বত্সর পর এই শ্রম জরিপ প্রকাশকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এখন হইতে প্রতি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে এই ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করিবার সিদ্ধান্তটিও প্রশংসনীয়।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন