সোমবার, ০৫ জুন ২০২৩, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী উদযাপনের সময়ে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৬:০৩

পৌরাণিক চরিত্র রামচন্দ্র, যাকে ভারতের হিন্দুদের একটা বড় অংশ তাদের ভগবান বলে মনে করেন। তার জন্ম উৎসব রামনবমী উদযাপন হয় বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ)। এই রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা আর লাগোয়া হাওড়া শহরের কয়েকটি জায়গায় সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।

সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, হাওড়া শহরের কাজীপাড়া এলাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রামনবমীর মিছিল ঘিরে বড় সংঘাতের সৃষ্টি হয়। বেশ কিছু দোকান ও গাড়িতে পাথর নিক্ষেপ ও আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এলাকাটিতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। 

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ওই ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন, 'তাদের মিছিল কেউ আটকায়নি। কিন্তু হাওড়ায় তাদের অস্ত্র আর বুলডোজার নিয়ে মিছিল করার অধিকার কে দিল? সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানোর জন্য তারা বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসেছিল।'

মিছিলটি নির্ধারিত পথ বদলে একটি সম্প্রদায়কে নিশানা বানিয়েছিল বলেও মমতা মন্তব্য করেন। এছাড়া কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় একটি মসজিদের সামনে দিয়ে রামনবমীর মিছিল যাওয়ার সময়ে সংঘর্ষ হয় বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী

এ সময় বেশ কয়েকটি মোটরবাইক আর গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এ রকম অশান্তি হতে পারে, এই আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গের শিল্প শহর আসানসোলের এক স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রীই বৃহস্পতিবার স্কুলে আসেনি।

ওই স্কুলের এক শিক্ষিকা বলেন, 'ওদের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে আজ রামনবমী, বাইকে করে অস্ত্র হাতে মিছিল বের হবে, যদি কোনো অশান্তি হয়, সেই ভয়ে বাবা-মায়েরা স্কুলে পাঠায়নি। আর সকাল থেকেই যেভাবে স্কুলের পাশে ডিজে বাজছে জয় শ্রীরাম করে, তাতে মনের মধ্যে একটা ভয় তো কাজ করছেই।'

এ রকম অশান্তি হতে পারে, এই আশঙ্কায় পশ্চিমবঙ্গের শিল্প শহর আসানসোলের এক স্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রীই বৃহস্পতিবার স্কুলে আসেনি।

তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে দিতে চাইলেন না, কারণ তিনি সরকারী স্কুলে পড়ান। শিল্পাঞ্চলের শহর রাণীগঞ্জ আর আসানসোলে ২০১৮ সালে রামনবমীর দিনেই হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বেঁধেছিল। সে বছর গোটা রাজ্যে রামনবমীকে কেন্দ্র করে দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক ইমাম পুত্রসহ অন্তত পাঁচজন।

রামনবমীর দিন বৃহস্পতিবার হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এবার পশ্চিমবঙ্গজুড়ে পাঁচশোরও বেশি মিছিল করেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু মিছিলে অস্ত্র প্রদর্শনও করা হয়। হিন্দুত্ববাদী নেতারা অবশ্য জানান, ওই অস্ত্র কাউকে ঘায়েল করার জন্য নয়, অসুর বধের প্রতীক তাদের ওই অস্ত্র।

শিল্পাঞ্চলের শহর রাণীগঞ্জ আর আসানসোলে ২০১৮ সালে রামনবমীর দিনেই হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বেঁধেছিল।

তবে কয়েক বছর আগেও এত সমারোহ করে রামনবমী পশ্চিমবঙ্গে উদযাপন হতো না। রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র কেয়া ঘোষ বলেন, 'ঠিকই, আগে সেভাবে পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী উদযাপন করা হতো না। কিন্তু এখন মানুষ বুঝতে পারছেন যে ভগবান রামচন্দ্র কোনো বিশেষ ধর্মের নয়, তিনি তো ভারতীয়ত্বের প্রতীক।'

কেয়া ঘোষ আরও বলেন, 'আমরা যে রামরাজ্যের কথা বলি, সেটা হলো একটা আদর্শ দেশ। আমরা তো রামরাজ্য স্থাপন করতে চাই। তেমনই পশ্চিমবঙ্গেও আমরা চাইব, রামরাজ্য স্থাপন করতে। আর যারাই ভগবান রামচন্দ্রকে পুজো করেন, তারাই রাস্তায় বেরুচ্ছেন, এটা তো সুখের কথা।'

রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র কেয়া ঘোষ

তার দাবি, রামনবমী উদযাপনের মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই। কিন্তু ঘটনাচক্রে, ২০১৮ সালে যখন আসানসোল রাণীগঞ্জে দাঙ্গা হয়েছিল রামনবমীর দিন, সেটা ছিল রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের আগে। তারপরের বছর আবার ছিল লোকসভা ভোট। সেই ভোটে বিজেপি ১৮ টি আসন জিতেছিল।

এ বছরও মাস কয়েকের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের ভোট আসছে। আবারও মহাসমারোহে রামনবমী উদযাপন করছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। যে উদযাপনের সামনের সারিতে বিজেপি নেতা-নেত্রীরাই থাকছেন। যদিও বিজেপি সরাসরি রামনবমীর দিন কোনো মিছিল করেনি।

২০১৮ সালে যখন আসানসোল রাণীগঞ্জে দাঙ্গা হয়েছিল রামনবমীর দিন, সেটা ছিল রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের আগে।

আবার রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও রামনবমী উদযাপন করছে বৃহস্পতিবার থেকেই। নানা জেলায় তাদের উদ্যোগে রামনবমীর মিছিল, পুজোও হচ্ছে। রামনবমীর দিনে ২০২২ সালেও পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতি বছরই সেই আশঙ্কা তৈরি হয়। 

মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, রামনবমীর মিছিল করতেই পারে কেউ, কিন্তু মুসলমান প্রধান এলাকায় অশান্তি বাধালে প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা নেবে। ওই স্কুল শিক্ষিকার কথায়, তাদের শহরে বড় সংখ্যায় অবাঙালি থাকেন, তাই রামনবমী সেখানে ছোট থেকেই উদযাপন হতে দেখেছেন।

আবার রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও রামনবমী পালন করছে বৃহস্পতিবার থেকেই।

তিনি বলেন, 'কিন্তু গত বছর দশেক ধরে রামনবমীর দিন যেভাবে অস্ত্র হাতে কপালে গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে বাইক বাহিনী রাস্তায় নামে, জয় শ্রীরাম রীতিমতো হুঙ্কারের স্বরে দেওয়া হয়, তাতে ভয় তো লাগেই। এভাবে রামনবমী কিন্তু আগে হত না।'

বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগঠন বাংলা পক্ষের প্রধান গর্গ চ্যাটার্জী জানিয়েছেন, অনেক এলাকাতেই বাঙালিরা বিপদে রয়েছেন। শুধু আসানসোল রাণীগঞ্জে নয়, কলকাতা, হাওড়া, লিলুয়া, খড়্গপুর, ভাটপাড়া, শিলিগুড়ির মতো অনেক শহরেই বাঙালীরা, বিশেষ করে নারীরা ত্রস্ত।

বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগঠন বাংলা পক্ষের প্রধান গর্গ চ্যাটার্জী

তিনি জানান, বাঙালী হিন্দুরা তো রামচন্দ্রের পুজো সেভাবে করতই না কখনও। এটা একটা নতুন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। যেসব এলাকায় রামনবমী মহা ধূমধাম করে করা হচ্ছে, সেখানে বহিরাগত তোষণ এবং তার ফলে অবারিত জনবিন্যাস বদলই প্রত্যক্ষভাবে দায়ী এর জন্য।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরুন্ধতী মুখার্জী জানান, শুধু যে রামনবমী পালনের হিড়িক বেড়েছে পশ্চিমবঙ্গে, তা নয়। এখানে হনুমান মন্দির আর পুজোর চল যেমন বেড়েছে, তেমনই মূলত মহারাষ্ট্রে যে গণেশ চতুর্থী পালন করা হতো, সেটাও পশ্চিমবঙ্গের পাড়ায় পাড়ায় করা হচ্ছে।

বাঙালী হিন্দুরা তো রামচন্দ্রের পুজো সেভাবে করতই না কখনও।

তিনি আরও জানান, অযোধ্যার রামমন্দির আন্দোলন বা ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়েও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী পালনের এ রকম ধুম পড়েনি। এই যে রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী এসব বেড়েছে গত কয়েক বছরে, তার পেছনে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটা অবদান তো আছেই।

অরুন্ধতী মুখার্জী আরও বলেন, 'কিন্তু একই সঙ্গে বলব গত দশ বছরে এধরণের আরও অনেক পুজো বেড়ে গেছে। আসলে ধর্মটাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় স্তরে ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটা উপায় হয়ে গেছে এগুলো। ধর্মকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষকে জড়ো করছে ওইসব ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিরা। তারা নিশ্চিতভাবেই রাজনীতির মানুষ।'

ইত্তেফাক/ডিএস

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন