মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

‘আকাশ যেন কালো মেঘে অন্ধ হলো’

আপডেট : ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩৮

দ্বন্দ্ব-সংঘাত নূতন কোনো বিষয় নহে। অর্থাৎ আমাদের এই সাধের পৃথিবী কখনোই পুরোপুরি শান্ত ছিল না। তিনটি বড় ধর্মের বিশ্বাসে আছে, মানবজাতি সৃষ্টির শুরুতেই আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-এর প্রথম সন্তান কাবিল হত্যা করিয়াছিল অনুজ হাবিলকে। ইহার পর হইতেই পৃথিবী যত ব্যাপৃত হইয়াছে, মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘাত দেখা গিয়াছে। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী হইয়া এক জাতি ধ্বংস করিয়াছে আরেক জাতির শহর, বন্দর, জনপদ, সংস্কৃতি, সম্পদ; হত্যা করিয়াছে নিরীহ শত শত, হাজার হাজার মানুষ। আধুনিক সময়ে আসিয়া গোলাবারুদ ট্যাংক-কামান আবিষ্কৃত হইবার পর, বিশ্বে যোগাযোগব্যবস্থা দ্রুত হইবার পর আমরা দুইটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হইতে দেখিয়াছি, যাহাতে কোটি কোটি মানুষের জীবন হরণ হইয়াছে। একপর্যায়ে গিয়া আলোচনার মাধ্যমেই হউক বা জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়াই হউক সেই যুদ্ধের অবসান ঘটিয়াছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে সংঘাত-সহিংসতার যে রূপ ধারণ করিয়াছে তাহাতে যথেষ্ট শঙ্কা জাগাইয়া তুলিয়াছে যে, এই পরিস্থিতি সহসা সমাধানের সম্ভাবনা নাই। আমাদের জানা ইতিহাসে গোটা পৃথিবী একসঙ্গে এই ধরনের সার্বিক বিপদে আর কখনোই ছিল না। ইহার শেষ কোথায় এবং বিশ্বকে কত হেনস্তা হইতে হইবে, তাহা কেহই অনুমান করিতে পারিতেছে না। কারণ একবিংশ শতাব্দীতে আসিয়া বিশ্বে বহু শক্তি বহু মুরুব্বির আবির্ভাব ঘটিয়াছে। যেন কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান। গত বৎসর  ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করিয়া বৈশ্বিক এই দ্বন্দ্ব সংঘাত আরও প্রকাশ্য ও তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা শুরু হইয়াছে তাহা বিশ্বের বহুগুলি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করিয়াছে। নূতন করিয়া চীন-তাইওয়ান পরিস্থিতি লইয়া যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে যে চরম পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছে তাহা আরও শঙ্কা জাগাইয়া তুলিতেছে।

সর্বত্র যে অস্থিরতা তাহার মধ্যে নিঃসন্দেহে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধই মুখ্য। ইহা অনেকটা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করিতেছে। এমনিতেই আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলি খরা-দুর্ভিক্ষপ্রবণ। যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্যসংকট তাহাদের আরও নাস্তানাবুদ করিয়া ছাড়িতেছে। ইহার মধ্যেই আবার শক্তিশালী দেশগুলি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে আরও তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। সেই সঙ্গে দেশে দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরম বৈরিতায় রূপ লইতে দেখা যাইতেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল-ইরান সংঘাত, ইয়েমেন-সৌদি আরব সংঘাত তীব্র হইয়া উঠিয়াছে। পূর্ব ইউরোপের বলকান অঞ্চলের দেশগুলি আপাতদৃষ্টে এত কাল শান্ত থাকিলেও নূতন করিয়া তাহারা উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে চলিতে শুরু করিয়াছে। এশিয়ায় তাইওয়ান-সংকট পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ধনী-দরিদ্র প্রতিটি দেশকে হুমকির মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নাই উপমহাদেশের দেশগুলিতেও। একদিকে রাজনৈতিক সংঘাত, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি উপমহাদেশের জনগণকেও অস্থির করিয়া তুলিয়াছে।  

আরও আশঙ্কার বিষয় হইল, রাষ্ট্রগুলির মধ্যে আপসরফা করিবার জন্য, আলোচনা চালাইবার জন্য জাতিসংঘসহ যে সংগঠনগুলি সৃষ্টি হইয়াছিল, বিশেষ করিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তাহা বহু মুরুব্বির কবলে পড়িয়া আজ তাৎপর্য হারাইতে বসিয়াছে। কারণ এই সময় আসিয়া শক্তিধর দেশগুলির মধ্যে কেহ কাহাকেও পরোয়া না করিবার প্রবণতা দেখা দিয়াছে। সার্বিক পরিস্থিতি মিলাইয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পলাতকার সেই চরণ দুটিই উচ্চারণ করিতে হয়, ‘আকাশ যেন কালো মেঘে অন্ধ হলো/ হঠাৎ এলো কোন দশমী সঙ্গে নিয়ে ঝঞ্ঝার গর্জন’। এহেন পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে দীর্ঘমেয়াদি সংকট মোকাবিলার কথা মাথায় রাখিয়া আগাইতে হইবে। দিতে হইবে ধৈর্যের পরীক্ষা। থাকিতে হইবে ঐক্যবদ্ধ। তাহা হইলেই সকলে মিলিয়া পরিস্থিতি হইতে উত্তরণ সম্ভব হইবে।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন