রাজধানীতে গড়ে উঠা ভবনগুলো অবকাঠামোর অবস্থা নিরূপণ ও নির্মাণাধীন ভবনের কাজ তদারকিতে থার্ড পার্টি নিয়োগের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি নগর উন্নয়ন কমিটির এক কার্যপত্রে এসব সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়।
এ সংক্রান্ত একটি কার্যবিধি/গাইডলাইন প্রণয়ন করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা), সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ), আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের পরিচালক, নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের প্রতিনিধি। শিগগিরই তারা বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসবেন।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় জানানো হয়, ভৌগোলিকভাবে ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় বাংলাদেশ ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির দিক হতে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সম্প্রতি দ্য গ্লোবাল আর্থকোয়াক ডিজাসটার রিস্ক ইনডেক্স (ইডিআরআই) রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বের ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের মধ্যে একটি অন্যতম শহর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট’-এর আওতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওন ১৫২৮ বর্গ কিমি এলাকার সমীক্ষায় নিরূপণ করা হয়েছে।
সমীক্ষায় বলা হয়, টাঙ্গাইলের মধুপুরে দিনের বেলা ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে রাজধানীর ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫টি (৪০.২৮%) হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় এ ভূমিকম্প হলে মারা যাবেন ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ, আহত হবেন ২ লাখ ২৯ হাজার। ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে সরকারকে ব্যয় করতে হবে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা।
সিলেটের ডাউকি চ্যুতিরেখায় ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে ঢাকার কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫টি (১.৯১%) ভবন ধসে পড়বে। দিনের বেলায় ভূমিকম্পটি হলে ১৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। আহত হবেন ২৮ হাজার মানুষ। এই মাত্রার ভূমিকম্পে আর্থিক ক্ষতি হবে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, যা সাড়ে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকার সমান। ভূমিকম্পের পর ভবন মেরামত ও পুনর্নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার (সাড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা)।
গত ১১ মার্চ নগর উন্নয়ন কমিটির এক সভা হয়। সভায় নেওয়া বেশকিছু সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে কার্যপত্রে। ভবনের সমীক্ষা ও নির্মাণকাজ তদারকিতে থার্ড পার্টি অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে কারিগরি ব্যক্তির সহায়তায় ভবনে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র নিয়মিত তদারকি, ব্যতয় পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা, রাজউকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ভবনের নকশা প্রস্তুত, পরিদর্শন ও বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের কঠোর জবাবদিহির মধ্যে আনা ইত্যাদি। এছাড়া মহানগরীতে সম্প্রতি বিভিন্ন ভবনে যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার কারণ উদ্ঘাটনে কী কী ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, সে বিষয়ে রাজউক কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনাসহ একটি প্রতিবেদন আগামী সভায় উপস্থাপন করা হবে।
সভায় বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে গ্যাস ফায়ার একটি সিরিয়াস ইস্যু। বাসা-বাড়িতে এস-ট্র্যাপ ব্যবহার করা যাবে না, মাস্টার ট্র্যাপ লাগাতে হবে। গ্যাস সেন্সর দিতে হবে। রাজউকের অনুমোদিত নকশা ও বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন হচ্ছে কি না, তা তদারকি করতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেছেন,‘ঢাকার ৯০ শতাংশ ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির ব্যত্যয় ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে রাজউকের দায় রয়েছে।’
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা বলেছেন, ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নানা বিপর্যয়ে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকাজ করা সম্ভব হবে না।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) প্রকৌশলী মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী বলেছেন, সিদ্দিক বাজারসহ প্রতিটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার রাখার বিষয়ে বাড়ি মালিকদের সচেতন করতে হবে। বেজমেন্টে যেকোনো দাহ্য পদার্থ রাখা বন্ধ করতে হবে।
সভায় রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান মিঞা, রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, স্থাপত্য অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি, দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, রিহ্যাবের সভাপতি, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, তিতাসের চেয়ারম্যান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ও অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ উপস্থিত ছিলেন।