মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিস্ফোরণোন্মুখ উন্নয়নশীল বিশ্ব!

আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৩, ০২:৩৮

ইউক্রেন যুদ্ধ চলিতেছে এক বত্সরেরও অধিক সময় ধরিয়া। এই যুদ্ধের অবসান কখন ঘটিবে তাহা আমাদের জানা নাই। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করিয়া এমন পরিস্থিতির তৈরি হইয়াছে যে, অন্যান্য দেশে বিরাজ করিতেছে থমথমে অবস্থা। ইউক্রেন যুদ্ধকে এখন স্পষ্টত বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতার লড়াই হিসাবে দেখা হইতেছে। ইহার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ নানা নেতিবাচক প্রভাব ও অভিঘাত পড়িতেছে বিভিন্ন দেশের উপর। ইহাতে সেই সকল দেশে মূল্যস্ফীতি ও সার্বিক অরাজকতার কারণে দেখা দিতেছে চাপা ক্ষোভ। বিরাজ করিতেছে এক গুমোট পরিস্থিতি। যে কোনো সময় এই সকল দেশে জনগণের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হইতে পারে। তাহার কিছু আলামতের বহিঃপ্রকাশ যে ঘটিতেছে না তাহা নহে; কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হইল তাহা কি আমরা একবার ভাবিয়া দেখিতেছি?

প্রথমত সমগ্র বিশ্ব আজ প্রধানত দুইটি ব্লকে ভাগ হইয়া পড়িয়াছে। একদিকে রহিয়াছে আমেরিকা ও ইউরোপের প্রভাবশালী দেশসমূহের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিশ্ব। অন্যদিকে রহিয়াছে রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলাসহ একনায়কতান্ত্রিক বিশ্ব। এই দুই বিশ্বের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্রমেই বাড়িতেছে। ইহাতে বিপাকে পড়িয়াছে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ। তাহাদের অবস্থা দাঁড়াইয়াছে শ্যাম রাখি না কুল রাখি। এই সকল ছোট, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহকে বৃহত শক্তিদ্বয় পক্ষভুক্ত করিবার চেষ্টা করিতেছে। এই দোটানায় তাহারা হইয়া পড়িয়াছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই পরিস্থিতির কারণে নিরপেক্ষ থাকা বা ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করাও কঠিন হইয়া পড়িতেছে। শাঁখের করাত আর কাহাকে বলে! জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন একসময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করিলেও এখন তাহার কোনো অস্তিত্ব নাই। এই দিক দিয়াও তাহারা নেতৃত্বহীন ও অসহায়।

দ্বিতীয়ত, সমগ্র পৃথিবীতে এই অস্থিরতা ও অসহায়ত্বের প্রভাব উন্নয়নশীল দেশসমূহের অভ্যন্তরে পড়িতেছে মারাত্মকভাবে। কোনো কোনো দেশে গণতন্ত্র থাকিলেও তাহা ক্রমেই একনায়কতন্ত্রের রূপ লাভ করিতেছে। প্রাধান্য পাইতেছে মাৎস্যন্যায় নীতি। সেই সকল দেশে ক্ষমতায় যাহারা আসিতেছেন, তাহারা ন্যায়-অন্যায় কোনো কিছুকে পরোয়া করিতেছেন না। ক্ষমতায় যাইবার জন্য কিংবা ক্ষমতায় টিকিয়া থাকিবার জন্য সেইখানে প্রাণান্তর সংগ্রাম পরিলক্ষিত হইতেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপব্যবহার ও প্রশাসনকে দলীয়করণসহ এমন অবস্থা তৈরি করা হইয়াছে যে, ক্ষমতাসীন ছাড়া আর কাহারো পক্ষে টিকিয়া থাকা কঠিন। এই সকল দেশে অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢুকিয়া পড়িয়াছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফলে ক্ষমতাসীনরা রাতারাতি আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ হইতে বটগাছে রূপান্তরিত হইতেছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দেখা দিতেছে অবক্ষয় ও স্থবিরতা। সেইখানে যুক্তিসংগত কোনো ঘটনা তেমন ঘটিতেছে না। ক্ষমতাসীন দলের অনুগত ও সমর্থক ঠিকাদাররা কাজ না করিয়াই বিল তুলিয়া লইতেছেন। বিভিন্ন স্থানীয় সরকারের অর্থ তুলিয়া দেওয়া হইতেছে দলীয় লোকদের নিকট। লোপাট করা হইতেছে জনগণের অর্থ; কিন্তু জনগণ তাহা কহিতে পারিতেছে না, সহিতেও পারিতেছে না। তাহাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়া গিয়াছে। এইরূপ প্রেক্ষাপটে তাহাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করা অস্বাভাবিক নহে।

এই ক্ষোভ যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হইবার আশঙ্কাকে অমূলক বলা যাইবে না। আইনের শাসন, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা ইত্যাদি না থাকিলে যে কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রে বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি হইতে বাধ্য। এই কথা চিন্তা করিয়া কি আমরা আমাদের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি সাজাইতেছি? বিশ্বে ইহাই হইল আজিকার ও এই মুহূর্তের সবচাইতে বড় ও কঠিন প্রশ্ন। ঝড়ের পূর্বে যেমন গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করে, তেমনি বিশ্ব যেন যুদ্ধবিগ্রহের নামে এক মহাবিপর্যয় ও দেশে দেশে আরও অশান্তি উৎপাদনের দিকে ধাবিত হইতেছে!

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন