আমরা আজ অতি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করিতেছি, যাহারা বর্তমান ক্ষমতাসীন দলকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, এই দলের বিরুদ্ধে যাহারা রক্তের মধ্যে বৈরিতা পোষণ করে, তাহারাই আজ এই দলকে যেন জাপটাইয়া ধরিয়াছে। এই লোকগুলি প্রকাশ্যে দুর্নীতি যত রকমের বেআইনি পথে অর্থসমাগম হয়—সকল পথে পা রাখিয়াছে। এই চিত্র সারা দেশেরই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল অসাম্প্রদায়িক, উন্নত একটি বাংলাদেশের। এই রাজাকার, আলবদর, আলশামস তথা স্বাধীনতাবিরোধীদের দিয়ে কি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়া যাইবে? ইহাদের দিয়া কি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাইবে? অবাক হইতে হয়, যাহাদের স্বাধীন দেশে পরিচয় দেওয়ার কোনো মুখ ছিল না, ভাষা ছিল না, তাহারাই এখন বড় বড় কথা বলে, বড় বড় নির্দেশনা দেয়। এককালে যাহারা চোখের উপর চোখ রাখিয়া কথা বলিবার সাহস পাইত না, এখন তাহারা নানাভাবে ধৃষ্টতা দেখাইতে চাহে। অবস্থা এখন এমন জায়গায় গিয়া দাঁড়াইয়াছে যে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করিতে স্বাধীনতাবিরোধীদের আর প্রতিরোধ করিতে হইবে না। অর্থাৎ, স্বাধীনতাবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করিতে ‘দিবে না’ অবস্থা হইতে ‘ক্ষমতাসীনরাই তাহা করিতে পারিবে না’—পর্যায়ে চলিয়া আসিয়াছে। প্রতিনিয়তই বিশ্বের নিকট ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার পাত্র করিতেছে তাহারা।
এই অবস্থা কী করিয়া হইল? সেই যে ব্রিটিশরা ডিভাইড অ্যান্ড রুলস নীতি দিয়া এই উপমহাদেশকে লইয়া খেলিয়াছিল, সেই খেলা এখনো অনেকেই খেলিতে গিয়া বিপদে পড়িতেছেন। এই ক্ষেত্রে এক কথায় বলিতে হয়—বেশি খেলা ভালো নহে। খেলিতে গিয়া এই স্বাধীনতাবিরোধীদের পুষ্টিসাধন করিয়াছে স্বাধীনতার পক্ষের লোকেরাই। সরকার যে অবগত নহে তা নহে। এমনকি সরকারপ্রধানও ইহাদের সম্পর্কে বারংবার সতর্ক করিয়াছেন। বলিতেছেন—ষড়যন্ত্র হইতেছে। তিনি প্রায়শই এই কথা বলিতেছেন। কিন্তু তাহার পর? তাহার পর তিনি কী ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন?
বিষবৃক্ষদের পুষ্টিসাধন করিলে তাহাদের বিষাক্ত ফল তো সেই আশ্রয়কারীদের গ্রহণ করিতেই হয়। ইহা সময়ের ব্যাপার মাত্র। অথচ এই আওয়ামী লীগের ইতিহাস ত্যাগ-তিতিক্ষার ইতিহাস। অনেক রক্ত, শ্রম, অত্যাচার, জেল-জুলুমের বিনিময়ে এই আওয়ামী লীগ গড়িয়া উঠিয়াছে। সুতরাং এখন যখন স্বাধীনতাবিরোধীরা ইহার অন্দরে ঢুকিয়া অর্থের বিনিময়ে পদপদবি কিনিয়া অন্যদের দিকে চোখ রাঙায়, তখন সর্বনাশের আর কী বাকি থাকে? স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন ফণা তুলিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। ছোবল মারিবার অপেক্ষায় রহিয়াছে। আঘাত তাহারা করিবেই, ছোবল তাহারা মারিবেই। এই ছোবল মারিবার জন্যই তাহারা অনুপ্রবেশ করিয়াছে ক্ষমতাসীনদের ভিতরে। কেবল ক্ষমতাসীনদের দলেই নহে, সকল দলেই তাহারা অনুপ্রবেশ করিয়াছে। ইহাদের বহুকালের উদ্দেশ্য হইল আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বিলীন করা। তাহারা সেই দিকেই অগ্রসর হইতেছে।
আমরা কিছুদিন ধরিয়া বারংবার এই কথাগুলি বলিতেছি। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতি দেখিয়া মনে হইতেছে, পানি ইতিমধ্যে বহু দূর গড়াইয়া গিয়াছে। আমাদেরও হয়তো দেরি হইয়া গিয়াছে এই কথাগুলি বলিতে। আমাদের যতক্ষণ নিশ্বাস রহিয়াছে ততক্ষণই লড়াই করিয়াই বাঁচিয়া থাকিতে হয়। নিশ্বাস তো একসময় থামিয়াই যাইবেই। কিন্তু ফণার ছোবল খাইবার পূর্বে কি শেষ লড়াই করিয়া যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ নহে? আরেকবার না-হয় লড়াই হইয়া যাক।