মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

নির্মম সত্য উপেক্ষা করা উচিত নহে

আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২৩, ০২:৩০

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ক্ষমতায় থাকিবার জন্য ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন ধরনের সহায়তাকারী লাগে। সহায়তাকারী মানে কী? তাহারা বন্ধু, নাকি বসন্তের কোকিল? প্রকৃত বন্ধু কে? ইহার সংজ্ঞায় বলা যাইতে পারে—যিনি বা যাহারা মরুতপ্ত রোদে, তুষারাবৃত পথে, কৃষ্ণঘন রজনিতে কিংবা সকল ধরনের প্রতিকূল পরিবেশে পাশে থাকেন—তিনি প্রকৃত বন্ধু। বন্ধুত্বের দর্পণে বাংলায় একটি প্রবাদ রহিয়াছে—‘সুসময়ে অনেকেই বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়।’ এই জন্য আমরা দেখিতে পাই—প্রকৃতিতে যখন ফুলের মেলা বসে, গাছে গাছে যখন সবুজ পাতার ছড়াছড়ি হয় তখনই প্রজাপতির মেলা বসে। মৌমাছি ব্যস্ত হয় মৌ সংগ্রহে। শীতের শীর্ণ গাছে কোকিল বসিতে দেখা যায় না। কিন্তু বসন্তে গাছে গাছে যখন গজাইয়া উঠে নূতন কুঁড়ি আর হরিত পত্র—বসন্তের কোকিল তখন কুহুকুহু রবে মাতোয়ারা করিয়া তোলে সারা এলাকা। যুগে যুগে বসন্তের কোকিলেরা এইভাবে সুসময়ে আসিয়া সমস্ত চরাচরে তাহাদের কণ্ঠের দাপটে রাষ্ট্র করিয়া দেয়—তাহারা রহিয়াছে, তাহারাই কেবল রহিয়াছে—জগতে যেন আর কেহ নাই! বারংবার ক্ষমতায় ফিরিয়া আসিবার জন্য ক্ষমতাসীনরাও এই দুর্নীতিগ্রস্তদের সহায়তা লইতে দেখা যায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ক্ষমতায় ফিরিয়া আসিবার জন্যই তাহারা এই ধরনের সুবিধাভোগীদের সৃষ্টি করিয়া থাকে। অবস্থা এমন হয় যে, ঐ সুবিধাভোগী কোকিলরা নিজেদের স্বার্থেই ক্ষমতাসীনদের ধারাবাহিকতা ধরিয়া রাখিতে চাহিবে। মনে করা হয়, একদম তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত এই কোকিলদের সংখ্যা যত বেশি হইবে তত বেশি সুবিধাজনক অবস্থা থাকিবে ক্ষমতা ধরিয়া রাখিবার ক্ষেত্রে।

তবে নির্মম সত্য হইল—কেহ চিরকাল ক্ষমতা ধরিয়া রাখিতে পারে নাই। হয়তো কেহ দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বৎসর ক্ষমতার আসমানে অবস্থান করিতে পারে—ইহা একেক দেশে একেক রকম—কিন্তু শেষ ফলাফল হইল ক্ষমতার আসমান হইতে তাহাকে একদিন জমিনে নামিয়া আসিতেই হইবে। এবং আরও একধাপ বাড়াইয়া বলা যায়—সকলকেই অন্ধকার মাটির ঘরে পাকাপাকি প্রবেশ করিতে হইবে। সকালে সূর্য উঠিলে উহাকে যেমন বিকালে অস্তাচলে আসন পাতিতেই হয়, জন্মিলে যেমন মরিতেই হয়—তেমনি ক্ষমতার সিংহাসন হইতেও একটি নামিতেই হয়। ইহা নেতিবাচক কোনো কথা নহে। ইহা হইল জগতের চিরন্তন বাস্তব কথা। আর এই বাস্তবতা ভুলিয়া কেহ যদি মনে করেন, মধ্যগগনের সূর্য কখনোই অস্ত যাইবে না, গোধূলিবেলা, সন্ধ্যাকাল এবং অমানিশাও আসিবে না কখনো—তাহারা নিঃসন্দেহে বোকার স্বর্গে বসবাস করেন।

ইহা গেল একটি দিক। অন্য দিক হইল, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ক্ষমতাসীনদের পতনের নেপথ্যে থাকিতে দেখা যায় তাহাদেরই তথাকথিত বিশ্বস্ত লোকদের। অথচ একটি সময় পর্যন্ত মনে হয় যেন তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সকল কিছুই তাহাদের সুবিধাভোগীদের নিয়ন্ত্রণে। এই সকল সুবিধাভোগী বসন্তের কোকিল ততদিন অবধি কুহুকুহু করে, যতদিন বসন্ত থাকে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের বসন্ত থাকে। কিন্তু বসন্ত ফুরাইয়া গেল, অর্থাৎ পতনের পর দেখা যায়, সকল কিছু তাসের ঘরের ন্যায় ভাঙিয়া পড়িয়াছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই দেখা গিয়াছে, বিপুল ক্ষমতাধরদের পতনের কিছু বৎসর পর তাহাদের এপিটাফে প্রদীপ দেওয়ার মতোও কেহ থাকে না। কাহারা বসন্তের কোকিল আর কাহারা প্রকৃত বন্ধু—সেই ব্যাপারে সচেতন থাকিবার শিক্ষা ইতিহাসই আমাদের দেয়। প্রকৃত বন্ধুরা না থাকিলে কী হয়, তাহার উদাহরণ বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের শুরুতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝিতেই পারেন নাই তাহার সবচাইতে কাছের লোকজনই ষড়যন্ত্রে শামিল হইয়াছেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে নবাবকে বিভ্রান্ত করিয়া যুদ্ধবিরতির পরামর্শ দেন তাহারই নিকটজন। সুতরাং শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকিলেও প্রকৃত বন্ধুর অভাবে পরাজয়ের শিকল পায়ে জড়াইতে পারে।

ইহাও মনে রাখিতে হইবে, ক্ষমতাকে যদি বসন্তের সহিত তুলনা করা যায়, তাহা হইলে এই বসন্তের সময় সকল পাখিই ‘কোকিল’ হইতে চাহে। সুতরাং বসন্তের সময় কোকিলদের মিষ্ট কুহুধ্বনি হৃদয়ে ভালোলাগার অনুভূতি জাগাইলেও তাহাই আসল চিত্র নহে।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন