মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে বিশাল মাঠ, তারই পাশে ছোট ছোট লালমাটির টিলা। সূর্য পশ্চিমে ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে সারাদিন ধরে রোজা রেখে ইফতার করার উদ্দেশ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে বসে আছে শিক্ষার্থীরা। আজানের একটু আগে কেউ হয়তো মাথায় টুপি দিচ্ছে, কেউবা ঘোমটা, কেউ ব্যস্ত মুড়ি মাখানোতে, কেউবা শরবত বানাচ্ছে। বলছিলাম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) কথা। প্রতিটি ইফতারের সময় এমন দৃশ্য দেখা মিলে বিশ্ববিদ্যালয়টির কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে।
রোজা মুসলিম শিক্ষার্থীদের কাছে ইবাদতের অংশ হলেও প্রতিটি ইফতারের সন্ধ্যা হয়ে ওঠে সৌহার্দ্য, অসাম্প্রদায়িকতার মিলনমেলা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষ পরিচয়ে একসঙ্গে হয়। শুধু কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার, মুক্তমঞ্চ, ব্যাডমিন্টন কোর্টসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের এই ইফতার আয়োজন দেখা যায়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী দীপ চৌধুরী দীপ এই ইফতারের আয়োজন সম্পর্কে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই আমাদের সবচেয়ে বেশি একাত্মবোধ কাজ করে। ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে থাকি। ধর্মীয় যেকোনো অনুষ্ঠান রোজা, ঈদ, পূজা, পূর্ণিমায় যখন স্ব স্ব ধর্মাবলম্বীরা আনন্দ করি তখন আমরা অন্য ধর্মের বন্ধুদেরকে আমাদের আয়োজনে যোগ করি। উৎসবগুলো উপলক্ষ মাত্র, আনন্দটা আমরা সবাই করি। রমজানের মাসে দুপুরের খাবার যোগাড় করতে কিছুটা কষ্ট হলেও দিনশেষে যখন মাঠে বসে একসঙ্গে ইফতার করি তখন সব কষ্ট ঘুচে যায়। মনে একাত্মতাবোধের প্রশান্তি আসে।'
এবারের রমজান অনেকেরই খুব আবেগের। কারও কাছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম কারও বা শেষ রোজা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১তম আবর্তন এবছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করার জন্য দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে চলে যাবেন। তাদেরই একজন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পাস জীবনের শেষ রমজান এটা। তাই এবারের রমজানটা আমার জন্য বিশেষ। অন্যান্য বার আনন্দ থাকলেও এবার যোগ হয়েছে আবেগ। আর হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে এই খোলা প্রান্তরে বসে ইফতার করা হবে না। পরিবারের বাইরে বন্ধুরা আমার আরেকটা পরিবার। এদের সঙ্গে শেষ মুহুর্তের স্মৃতিগুলো ধরে রাখতেই চতুর্থ রোজায় একসঙ্গে ইফতারের আয়োজন করি। আর শেষবারের মত এই আয়োজন আমাদেরকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত ১৬তম ব্যাচের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মারুফা খাতুন প্রথমবারের মতো এই অভিজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খাবার ভাগ করে খাওয়ার এমন সুন্দর অভিজ্ঞতা পূর্বে হয়নি। মাগরিবের আজানের আগ মুহূর্তে সবার মুখে যে হাসি দেখি তা যেন ক্লাসের সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। যখন কেন্দ্রীয় মাঠে বন্ধুরা মিলে ধর্মের ভেদাভেদ দূর করে একসঙ্গে খাবার খাই, তখন মনে হয় এইতো পেরেছি সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল ভেঙে নতুন প্রজন্মের সাক্ষী হতে।’