মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সময় এখন সৌহার্দের, ভ্রাতৃত্বের

আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৩০

আজ, ১৪ এপ্রিল, বাঙালির প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। কতই-না হৃদয় উদ্ভাসিত করা বাংলার অপূর্ব মাটিগন্ধমাখা এই প্রাণের পহেলা বৈশাখ! যদিও এই সময় দাবদাহ বহিতেছে, তবে বাংলা নববর্ষ এমন একটি সময় শুরু হয়, যখন বসন্তের দহনকাল শেষে গ্রীষ্মের বিচিত্র রসালো ফলসম্ভারে ভরিয়া উঠে প্রকৃতি। আবহমানকাল ধরিয়া আমাদের বাংলা নববর্ষের সহিত নিবিড়ভাবে জড়াইয়া ছিল এই জনপদের ফসল ও ব্যবসায়-বাণিজ্যের হিসাবনিকাশ। ষোড়শ শতকে শুরু হয় এই বাংলা সন গণনা। উল্লেখ্য, প্রথম দিকে বাংলা নতুন বছর শুরু হইত অগ্রহায়ণ মাস হইতে। তবে পরবর্তীকালে বাদশাহ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এবং ফসল কাটার মরসুমের কথা মাথায় রাখিয়া বৈশাখ মাস হইতে চালু করা হয় এই ফসলি সন। ইহার ধারাবাহিকতায় পহেলা বৈশাখ হইতে শুরু হয় নূতন বছরের হিসাব রাখিবার পর্ব।

জমিদারি আমলে নববর্ষের ব্যাবহারিক প্রয়োগ তুঙ্গে উঠিয়াছিল আমাদের এই জনপদে। চৈত্র মাসের শেষ দিন ভূস্বামীরা খাজনা পরিশোধ করিয়া নূতন বছরের প্রথম দিন আয়োজন করিতেন উৎসবের। ইহাই জনপ্রিয়তা পায় বৈশাখী উৎসব বা বৈশাখী মেলা হিসাবে। নববর্ষের চিরাচরিত উৎসবের মধ্যে রহিয়াছ হালখাতা, চাষাবাদ, বীজ বপন, বৈশাখী মেলা, মধুমাসের মেলা ও আঞ্চলিক উৎসব। তবে নববর্ষের মূল আকর্ষণ ছিল ‘হালখাতা’। হালখাতা শব্দবন্ধটির সহিত মুসলিম শাসনের অনুষঙ্গ জড়াইয়া আছে। ‘হাল’ আর ‘খাতা’—ব্যুৎপত্তির দিক দিয়া শব্দ দুইটি আরবি-ফারসি সঞ্জাত। ইহার অর্থ—নূতন খাতা। সুতা দিয়া বাঁধানো লাল খেরো হৃষ্টপুষ্ট খাতা ইহার প্রধান উপকরণ। ইহাতে ব্যবসায়ীরা তাহাদের লেনদেন, বাকি-বকেয়া—সকল কিছুর হিসাবনিকাশ লিখিয়া রাখিতেন। এই ব্যাপারে একটি বিষয় স্পষ্ট করা উচিত যে, হালখাতার সহিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কোনো সম্বন্ধ নাই। সাধারণত মুসলিম ব্যবসায়ীরা তাহার হালখাতার ওপর ‘এলাহি ভরসা’ আর হিন্দু ব্যবসায়ীরা ‘গণেশায় নমঃ’ লিখিয়া থাকেন নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী। জগতের বস্তুগত সকল কিছুর সহিত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাণিজ্যের বিষয়টি জড়াইয়া রহিয়াছে। বাজারসংস্কৃতির কারণেই এই বিশ্বের বিভিন্ন জনপদ আসিয়াছে পরস্পরের নিকট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যেই প্রবেশ করিয়াছিল ভারতবর্ষে। ভাস্কো-দা-গামা, কলম্বাস, আমেরিগো জাহাজ ভাসাইয়াছেন বাণিজ্যের প্রসারেই। শেষ অর্থে একটি জনপদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখানকার বাণিজ্যের ব্যাপ্তি বা পরিসর। আমাদের বাংলা নববর্ষও এককালে ছিল সেই ব্যবসায়-বাণিজ্যেরই ধারক। বর্তমানে ইহা হইয়া উঠিয়াছে ঐতিহ্যের ধারক। রাষ্ট্রীয় জীবনে বঙ্গাব্দের প্রত্যক্ষ কোনো প্রভাব না থাকিলেও হালখাতা কোথাও কোথাও এখনো টিকিয়া আছে টিমটিম করিয়া।

বৈশাখ আসিলেই রবীন্দ্রনাথের সুরে আমরা আওড়াই—‘মুছে যাক গ্লানি মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ সেই যে কবি বৈশাখের আবাহনে উচ্চারণ করিয়াছিলেন ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’—সেই আবাহনেই কবি বলিয়াছেন—‘ছাড়ো ডাক, হে রুদ্র বৈশাখ! ভাঙিয়া মধ্যাহ্নতন্দ্রা জাগি উঠি বাহিরিব দ্বারে, চেয়ে রব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে নিস্তব্ধ নির্বাক। হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!’ কবি নজরুলের প্রলয়োল্লাসের ঝড় বইছে বিশ্বব্যাপী। ইহার ভিতরেই কবি বলিয়াছেন—‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর! ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বোশেখির ঝড়।’ বাংলা নববর্ষ আমাদের অন্তরকে বিকশিত করে, নিজের মাটিকে চিনায়, শেকড়কে চিনায়। তবে আজি, এই ১৪৩০ বঙ্গাব্দে আসিয়া যেই অভাবিত দুর্যোগের মুখোমুখি হইতে যাইতেছি আমরা, তাহা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার। পৃথিবীময় অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সংকট তো রহিয়াছেই, আগামী ১৪৩১ বঙ্গাব্দের পূর্বেই আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন পার করিব। আসন্ন নির্বাচন লইয়াও একধরনের অস্থিরতার পারদ ক্রমশ চড়িতেছে।

পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরিয়া মহামারি, যুদ্ধবিগ্রহ ও অর্থনৈতিক মন্দা আসিয়াছে বটে, বাংলা নববর্ষের এই শুভ দিনে আমরা আশা রাখিব—মানুষের হিতার্থে এই সকল সংকট এই বিশ্ব হইতে ক্রমশ বিদূরিত হইবে। সময় এখন সৌহার্দের, ভ্রাতৃত্বের। সকলের শুভ হউক। শুভ হউক ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। শুভ নববর্ষ।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন