শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

মজিদ মাহমুদের জন্মদিনে শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা: বোধি লাভের দর্শন

আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২৩, ২২:০৯

সময়টা ২০১৪ সাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পুরোনো বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি। উদ্দেশ্য ভালো বই কেনা। চোখে পড়লো ‘মজিদ মাহমুদ এর মাহফুজামঙ্গল পঁচিশ বছরের পাঠ’ বইটি। কিছুটা রুচিশীল আমি বই কেনার ব্যাপারে। যে কারণে দোকানে দাঁড়িয়ে পাতার পর পাতা উল্টালাম বইটির। নিবিড় কোনো স্পর্শ যেমন অবশ করে দেয়, বিহব্বল করে দেয়, সে সময়ে আমার তেমনই মনে হলো। একজন বোধিজ্ঞানপ্রাপ্ত কবির চেতনাকে ছুঁয়ে গেলাম সে মুহূর্তে যখন কবি বলেন-

‌ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়
আমি প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে
সেই নারী এসে আমার হৃদয়মন তোলপাড় করে যায়
তখন আমার রুকু
আমার সেজদা 
জায়নামাজ চেনে না
সাষ্টাঙ্গে আভ‚মি লুণ্ঠিত হই 
এমাটিতে উদগম আমার শরীর 
এভাবে প্রতিটি শরীর বিরহজনিত প্রার্থনায় 
তার স্্রষ্টার কাছে অবনত হয়
তার নারীর কাছে অবনত হয়
(কুরছিনামা, মাহফুজামঙ্গল)

অথবা কবি বলেন :
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি শ্রমণ গোতম বোধিসত্ত্ব মহাস্থবির
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি প্রবুজিত ভিক্ষুসংঘ
মাহফুজা এবার আমি গ্রহণ করেছি ধর্ম শরণং গচ্ছামি
মাহফুজা শরনং গচ্ছামি
নির্বাণ শরনং গচ্ছামি  
(মাহফুজা শরণং গচ্ছামি, মাহফুজামঙ্গল)

তারপর থেকে কবি মজিদ মাহমুদের (জ. ১৯৬৬) বই প্রচুর সংগ্রহ করেছি। এছাড়াও তার বহুস্বরিক পাণ্ডিত্য, বিষয়কে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, তথ্যের ভাণ্ডার, প্রসঙ্গকে বহুরৈখিকভাবে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গি গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি সত্যিকারভাবেই সুবক্তা ও যুক্তিবাদী। যে কোনো বিষয়ের নিবিড় পর্যবেক্ষক। যা হোক, ২০১৮ সালের শুরুতে কবির সাথে পাবনায় আার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। এভাবেই তাকে আরও নিবিড় করে জানার সুযোগও তৈরি হতে থাকে। 

মজিদ মাহমুদ আশির দশকের একজন স্বাতন্ত্র্যবাদী ও প্রভাববিস্তারী করি। যাঁর কাব্যদর্শন, নির্মাণকলার নিজস্বতা ও ব্যতিক্রমী চৈতন্যের প্রকাশ একক ও অনন্য। শব্দের গূঢ় অর্থবোধকতা, চিত্রকল্পের নিটোল গ্রন্থনা ও ভাষাশৈলির প্রাঞ্জলতা তাঁকে করেছে অনিবার্য। বিচিত্র দার্শনিকতা, কাব্যকলায় ব্যতিক্রম ব্যঞ্জনাসৃষ্টি, উপলব্ধির অন্যতর মাত্রা বিনির্মাণ করে তিনি বিপরীত স্রোতে উজিয়ে চলেছেন। অর্জিত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি চেতনাকে তিনি নিয়োজিত করেছেন শিল্প নির্মাণের হাতিয়ার হিসেবে। প্রতিটি লেখায় তিনি দর্শনবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা ও প্রজ্ঞায় ক্রমে ক্রমে আরো উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছেন। 

ভঙ্গিবৈচিত্র্যের নানা মাত্রিক কলাকৌশলে তার লেখাগুলো বহুরৈখিক ও ভাস্কর। মানদণ্ডের পারদকাঁটায় মজিদ মাহমুদের লেখক মাহাত্ম্য সদর্থক অর্থেই তাই বিরল। মজিদ মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মাহফুজামঙ্গল’ (১৯৮৯)। বেরিয়েছে কবির তেইশ বছর বয়সে। তারপর একে একে বেরিয়ে গেছে তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ ‘গোষ্ঠের দিকে’ (১৯৯৫), ‘বল উপাখ্যান’ (১৯৯৮), ‘আপেল কাহিনি’ (২০০১), ‘ধাত্রী ক্লিনিরে জন্ম’ (২০০৬), ‘অনুবিশ্বের কবিতা’ (২০০৭), ‘দেওয়ান-ই মজিদ’ (২০১০), ‘সিংহ ও গর্দভের কবিতা’ (২০১৩), ‘সন্ত কবিরের দোঁহা’ (২০১৪), ‘গ্রামকুট’ (২০১৬), ‘কাটাপড়া মানুষ’ (২০১৬), ‘শুড়িখানার গান’ (২০১৬), ‘লঙ্কাবি যাত্রা’ (২০১৬), ‘ষটকগুচ্ছ’ (২০২১), ‘খুঁত’ (২০২১) ও ‘শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা’ (২০২২)। এছাড়াও প্রবন্ধ, গবেষণা, কথাসাহিত্য, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য ও সম্পাদনা মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৫০ এর অধিক। 

কবি মজিদ মাহমুদের সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা’ (২০২২) আমাদের আলোচনার উপজীব্য। ‘বুনন’ জিন্দাবাজার সিলেট থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটির প্রচ্ছদ, বাঁধাই ও মুদ্রণের ত্রিমাত্রিক সমন্বয়ে কাক্সিক্ষত মাত্রা লাভ করেছে বলেই মনে হয়েছে। প্রচ্ছদ শিল্পী শ. ই. মামুনের প্রচ্ছদ পরিকল্পনাটিও ভিন্ন ধাঁচের। বইটির প্রধান আকর্ষণের বিষয় হলো ১ম ফ্লাপে মজিদ মাহমুদের কাব্যশক্তি নিয়ে সমকালের খ্যাতিমান লেখকদের মূল্যায়ন সন্নিবেশিত হয়েছে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবি শিমুল মাহমুদকে। চার ফর্মার নান্দনিক এ গ্রন্থটির মুদ্রণ পরিপাট্য ও অঙ্গসজ্জাও চিত্তাকর্ষক। তাহলেও চাঁদের কলঙ্কের মতো বর্ণবিন্যাসের ত্রুটি মনকে ভীষণ আহত করে। পরবর্তী সংস্করণে আশা করি ত্রুটিগুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেবেন লেখক এবং প্রকাশক উভয়েই।

মজিদ মাহমুদ সময় সচেতন কবি। স্বকালের যুগযন্ত্রণা, অধ্যাত্ম্য-ঊষরতা ও মানসদ্বন্দ্ব তাঁর কবিতার মূল প্রত্যয়। শব্দ চয়ন, বিষয় নির্বাচন, বাচনিক দিক ও দার্শনিকতার বয়ান তাঁর কবিতার অভিনব অনুষঙ্গ। সহজ সরল শব্দের ভেতর জীবনঘনিষ্ঠ উপাদান, ঐতিহ্যের যোগসূত্র, চিত্রকল্পের সমাহার বিশেষ বৈচিত্র্যে স্থান পেয়েছে তার কবিতায়। বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তিবাদিতা, ভাষা ব্যবহারে সংযম, বস্তুনিষ্ঠ আবেগ ও মনন, আত্মগত উপলব্ধি তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ‘শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা’ কাব্যগ্রন্থটিতেও মজিদ মাহমুদ তার কাব্যচরিত্রের এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। কাব্যবিষয় হিসেবে এখানে এসেছে ‘মৃত্যুচেতনা, ধর্ম ও বিজ্ঞান ভাবনা, স্রষ্টা ও সৃষ্টি রহস্য, করোনার আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যা পোড় খাওয়া জীবনের স্বরূপ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, প্রেম, সমাজ বাস্তবতা, দেশপ্রেম, আশাবাদ, দার্শনিক জীবনদৃষ্টি, নৈরাজ্যের প্রতি স্যাটায়ার ইত্যাদি। তবে মৃত্যুচেতনাই এই কাব্যের মূল সুর বলে উল্লেখ করা যায়। কবি বিস্তর পরিসরে এ কাব্যে মৃত্যু বিষয়ক ভাবনাকে স্থান দিয়েছেন। 

এই সংকলনের অধিকাংশ কবিতাই আপাতগ্রাহ্য ব্যক্তিগত লিরিকের আঙ্গিকে। স্তব বিভাজন ও অন্ত্যমিল বিন্যাসে ছন্দিত এর শব্দবন্ধ। শব্দের সঙ্গে শব্দের এমন বৈবাহিক যোজনা যেন এক দাম্পত্য মাধুর্য তৈরি করে চৈতন্য। প্রকরণের নতুনত্ব বা ছন্দের অপ্রচল ব্যবহার নয় বরং বাচ্যার্থের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিস্তৃতি এ কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাচ্যার্থের বিচিত্রমুখিতার কারণে কবিতাগুলো নতুন উপলব্ধির সামনে দাঁড় করায় পাঠককে। পাঠক পেয়ে যায় অধরা এক কাব্য-আস্বাদ। ফলে কবিতাগুলো হয়ে ওঠে অত্যন্ত যোগাযোগধর্মী। 

মজিদের অন্তর্দৃষ্টি এবং বিষয় বীক্ষণের ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতা অতুলনীয়। এক্ষেত্রে তাঁর প্রতিটি কবিতার পৃথকীযোগ্য পার্থক্য অবাক করার মতো। যা মনন নৈপুণ্যে একজন কবির প্রকৃত পরিচয়ও বটে। রহস্য, প্রেম, প্রকৃতি, মানব মনস্তত্ত্ব, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, মনোবিকলনতত্ত¡, সমাজের কুটকৌশল ও তার অপরিহার্য আলোচনা বরাবরই তাঁর কবিতার বিষয়কে করেছে বহুমাত্রিক। ‘শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা’ কাব্যগ্রন্থটিতে কবির মৃত্যুচেতনাই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। কাব্যের নামকরণটিও যেন এই মৃত্যুচেতনাকেই ধারণ করে আছে। সন্ন্যাসীতলা শব্দটি এখানে কবির মৃত্যুবোধেরই প্রতীক। মানবজীবনে মৃত্যু এক শোকোদ্দীপক ঘটনা। তবুও তার নিষ্ঠুর আকস্মিতা আমাদের শোকাবহ করে। শুরু থেকে শেষ অবধি এ কাব্যে মৃত্যুর অজস্র ভাবনা অপূর্ব গীতরূপ পেয়েছে, কখনো অপার বিষণ্ণতায়, কখনো বেদনার উল্লাসে কখনো কান্নার কলরোলে। মৃত্যুর ভাবনা মজিদ মাহমুদের এ কাব্যে নিরবছিন্ন। কবির জীবনোপলব্ধির নাভিমর্মে মৃত্যুর অব্যয় ভাবনা, অন্য সব ভাবনা ঘুরে ফিরে এই কেন্দ্রের সংযোগে সঞ্জীবিত।   
দৃশ্যের সকলে হয়েছে গত
তুমি কেবল মৃত্তিকার অমোচনীয় ক্ষত
এই মাঠে একদিন খাণ্ডব দাহন
কুরু পাণ্ডব ভ্রাতৃঘাতী রণ
তারা আছে নিশ্চিন্তে ঘুমায়ে মাঠে
ভুলো না সেই কথা নিমগ্ন পাঠে
মানুষের থাকিবার সাধ তবু এইখানে
থেমে যায় মৃতদের গানে।  
(শ্রী শ্রী সন্ন্যাসীতলা)

 

ইত্তেফাক/পিও