শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

প্রকৃতি সহিবে না এই নিষ্ঠুর খেলা

আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:০৫

প্রখ্যাত সুইস লেখক ও নাট্যকার ফ্রেডরিক ডুরেনম্যাট এই ধূলিধরাকে ‘অমানবিক’ হিসাবে আখ্যায়িত করিয়া সমাজের প্রতি প্রশ্ন রাখিয়াছিলেন—‘এই জগৎসংসারকে মানবিক করিয়া তোলা যাইবে কীভাবে, কোন উপায়ে?’ মহাকাব্যিক থিয়েটারের প্রবক্তা ডুরেনম্যাট গত হইয়াছেন তিন যুগ হইতে চলিল, তথাপি সমাজজীবনে মানবিকতার শক্ত খুঁটি প্রোথিত হইবার কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হইতেছে না। চলার পথে প্রতিনিয়ত অমানবিকতা, পাশবিকতার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করিয়া চলিয়াছি আমরা! প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের বাড়াবাড়ি চরম আকার ধারণ করিতেছে। ‘জগতে অমানবিকতা থাকবেই’—মনীষীদের মুখে আমরা এই ধরনের কথা শুনিয়াছি বটে; কিন্তু অমানবিকতা, পাশবিকতারও একটা ‘সীমা’ রহিয়াছে বইকি!

নিত্যদিনের নানা দুঃসংবাদ, দুর্ঘটনার ভিড়ে গতকাল মোটা দাগে দুইটি ঘটনা আমাদের মনে দাগ কাটিয়া গিয়াছে। ঘটনা দুইটি গোটা দেশবাসীকেই হতবাক করিয়াছে। পোশাক ক্রয়বিক্রয়ের সময় মাত্র দুই টাকা লইয়া দরকষাকষি ও বাদানুবাদ শেষ অবধি হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়াইতে দেখা গিয়াছে চুয়াডাঙ্গা জেলায়। পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দরদাম লইয়া বারগেইনিং থাকিবেই; কিন্তু সেই ঘটনায় কাহারও লাশ হইবার চিত্র নিতান্তই দুঃখজনক। এই ঘটনা আবারও আমাদের স্মরণ করাইয়া দিল, আমাদের সহ্য, ধৈর্যের বাঁধ কতটা ঠুনকো! সত্যি বলিতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘অসহিষ্ণুতা’ আমাদের মধ্যে এমন বিশাল শিকড় গজাইয়াছে যে, ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়াই বড় ধরনের অনর্থ ঘটাইবার প্রবণতা লক্ষ করা যাইতেছে। বাস্তবিক অর্থেই আমরা ভুলিয়া যাইতেছি, অসহনশীলতার বশবর্তী হইয়া এইভাবে আইনকে হাতে তুলিয়া লওয়ার সংস্কৃতি সমাজজীবনে কেবল অস্থিরতাই বাড়াইবে। এই ক্ষেত্রে বলিতে হয়, দুষ্কৃতকারীরা মনে করিতে পারে, অপরাধ করিয়াও আইনের ফাঁক গলিয়া বাহির হইয়া পড়া যাইবে। সত্যিই কি তাই? সমাজ, রাষ্ট্রজীবনে আইনের কঠোর প্রয়োগ কি ঠিকঠাকভাবে হইতেছে না তাহা হইলে?  

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটিয়াছে ফেনী জেলায়। বাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত জনৈক শাহীন হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়াও কোনো চিকিৎসাসেবা না পাইয়া শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করিয়াছেন বলিয়া অভিযোগ উঠিয়াছে। এই ঘটনাকে সহজভাবে দেখার কোনো অবকাশ নাই। আধুনিক, সভ্য জগতে চিকিৎসালয় পর্যন্ত পৌঁছাইয়াও বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনা মানিয়া লওয়া কষ্টসাধ্যই বটে। বিভিন্ন খাতের মতো চিকিৎসাসেবায়ও দেশ প্রভূত উন্নতি লাভ করিয়াছে। আধুনিক প্রযুক্তির চিকিৎসাসরঞ্জামও বসানো হইয়াছে অধিকাংশ সরকারি চিকিৎসালয়ে। ইহার পরও অক্সিজেন, আইসিইউ কিংবা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে রোগী মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগের সঞ্চার করে স্বভাবতই। এই ঘটনায় জানা গিয়াছে, দেশের বৃহত হাসপাতালসমূহ তন্ন তন্ন করিয়া ঘুরিয়াও শুধু আইসিইউ বেড খালি না থাকার কারণে বিনা চিকিৎসায় মরিতে হইল রোগীকে! একই সঙ্গে ইহাও পুনরায় সামনে আসিল—বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসা ব্যয় এতটা গগনচুম্বী যে, তাহা সম্পূর্ণরূপে দরিদ্র রোগীদের সাধ্যের বাহিরে! সাধারণত কোনো দেশে জনগণের সুখ-শান্তির অন্যতম নিয়ামক হইল মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা অনেক বড় বিষয়; কিন্তু যথাযথ নজরদারির অভাবের সুযোগ লইয়া বিভিন্ন সময় সরকারি হাসপাতালসমূহে একশ্রেণির কর্মচারীর অনিয়ম, দায়িত্ব পালনে অনীহার পাশাপাশি চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলার যেই চিত্র দৃষ্টিগোচর হয়, তাহাতে বলিতে হয়—এই অনিয়ম, অবহেলার ব্যত্যয় ঘটাইতে না পারিলে কালক্রমে তাহা বড় ক্ষয়ক্ষতি বহিয়া আনিবে। উল্লিখিত ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত এবং আনিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রত্যাশিত।

মহামতি হেলেন কেলার বলিয়াছেন, ‘শিক্ষার চূড়ান্ত ফল হইল সহনশীলতা’। দুঃখজনকভাবে বলিতে হয়, আজকের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসহনশীলতার ছড়াছড়ি! অর্থাৎ, প্রশ্ন রহিয়া যায়, আমরা প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করিতেছি কি না। আমরা কি আসলেই ভুলিতে বসিয়াছি এই মর্মবাণী—‘শেষ হোক যত বর্বরতা—প্রকৃতি সহে না এই নিষ্ঠুর খেলা।’

ইত্তেফাক/এমএএম