রোববার, ২৮ মে ২০২৩, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

দূষিত বাতাস ও ঢাকাবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০০:২৬

ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর। এমনকি একাধিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের সবচাইতে দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে রহিয়াছে ঢাকা। আমরা যাহারা ঢাকায় বসবাস করি এবং প্রতিদিন ঢাকার বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করি, তাহাদের নিকট ইহা কোনো নূতন খবর নহে। রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ লইয়া কত রিপোর্ট ও গবেষণা প্রকাশিত হইল এমনকি হাইকোর্ট পর্যন্ত নির্দেশনা দিল, তাহার পরও এই ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নাই। এই ব্যাপারে আমাদের যেমন সচেতনতা নাই, তেমনি দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে নাই সঠিক দায়িত্ববোধও। 

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকা চীনের উহান বা ভারতের নয়াদিল্লিকে পিছনে ফেলিয়া দিয়াছে। গত জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়িয়া আমরা হতবাক হইয়া গিয়াছিলাম। তাহাতে বলা হয়, গত ছয় বত্সরে ঢাকায় মাত্র ৩৮ দিন বিশুদ্ধ বাতাস পাওয়া গিয়াছে। একটি শহরের গ্রহণযোগ্য একিউআই স্কোর ০-৫০; কিন্তু স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক পলিউশন স্ট্যাডিজের (ক্যাপস) ২০১৬-২০২১ পর্যন্ত পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এই সময়ে ঢাকার গড় একিউআই স্কোর ছিল ২১৯। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্মল বায়ুর মান অনুযায়ী সাধারণত প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম ধূলিকণা ও গ্যাসীয় পদার্থকে সহনীয় মাত্রা হিসাবে বিবেচনা করা হয়; কিন্তু ঢাকার বাতাসে প্রায়শ ইহার পরিমাণ থাকে তিন গুণেরও অধিক। কখনো কখনো তাহা আড়াই শতাধিক মাইক্রোগ্রাম ছাড়াইয়া যায়। অর্থাৎ ঢাকার বাতাস কতটা অস্বাস্থ্যকর তাহা ইহাতেই সম্যক উপলব্ধি করা যায়।

সম্প্রতি ক্যাপসের প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন হইতেও ইহার ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। তাহাতে বলা হইয়াছে, গত আট বৎসরের মধ্যে এবার ঈদুল ফিতরের পাঁচ দিনের ছুটিতে ঢাকার বায়ুদূষণ ছিল সবচাইতে অধিক। সাধারণত ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাতাসের গড়মান ভালো থাকিবার কথা। কেননা এই সময় রাস্তায় যানবাহন চলাচল কমিয়া যায় এবং বন্ধ থাকে কলকারখানাগুলি। তাহার পরও বায়ুদূষণের গড়মান কীভাবে ১৫৩ হইল যেখানে গত বৎসর ঈদুল আজহায় ছিল ৯৬, তাহা একটি চিন্তার বিষয়ই বটে। অবশ্য এই সময় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং ঢাকা শহরের ইটভাটাগুলি চালু থাকিবার কারণে এমন পরিস্থিতির তৈরি হইতে পারে। যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হউক, ঢাকা শহরের বাতাস যে ভয়ংকরভাবে দূষিত তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।

উল্লেখ্য, ঢাকায় বায়ুদূষণের মধ্যে সবচাইতে অধিক ৩০ শতাংশ দূষণ হয় অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তাকাটা ও নির্মাণকাজের কারণে। ইহারপর ইটভাটা কলকারখানার ধোঁয়ায় ২৯ শতাংশ এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে ১৪ শতাংশ বায়ু দূষিত হইতেছে। ইহার কারণে অ্যালার্জি, গলায় ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, চোখের রোগসহ ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত রোগও ছড়াইয়া পড়িতেছে। তাহাছাড়া শ্বাসকষ্ট, ফুসফুস ক্যানসার, মানসিক চাপ বা উচ্চ রক্তচাপ, হূদেরাগ, স্ট্রোক, এলঝেইমার্স, পারকিন্সন, কিডনি রোগসহ অসংক্রামক বিভিন্ন রোগের জন্যও ইহা দায়ী; কিন্তু এই সমস্যা হইতে উত্তরণে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নাই বলিলেই চলে। মহামান্য হাইকোর্ট সার্বিকভাবে দেশের বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) ৯ দফা নির্দেশনা দিয়াছে। এই সকল নির্দেশনার মধ্যে রহিয়াছে—বর্জ্য বহনকারী যানবাহন, নির্মাণসামগ্রী ও নির্মাণকাজের স্থানগুলি ঢাকিয়া রাখা, ঢাকার রাস্তায় পানি ছিটানো ইত্যাদি; কিন্তু এই সকল নির্দেশনা মানা হইতেছে না দুঃখজনকভাবে। এই ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহিতার আওতায় আনিতে হইবে। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী যখন বাতাসের মান খারাপ অবস্থায় পৌঁছায়, তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের অবশ্যই স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে গণসচেতনতা জারি করিবার কথা; কিন্তু এই সতর্কতা জারিতেও সীমাহীন অবহেলা পরিলক্ষিত হয়।
 
বিশ্বব্যাংকের এক তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বৎসর শুধু ঢাকাতেই ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ এবং সমগ্র দেশে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। অতএব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়টিকে জরুরি অবস্থা হিসাবে বিবেচনা করিয়া সেই অনুযায়ী এখনই কার্যকর ব্যবস্থা লইতে হইবে। এই জন্য প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতকরণ কার্যক্রমে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, যানবাহনে মানসম্মত জ্বালানি ব্যবহার, নিম্নমানের লুব্রিকেন্ট ব্যবহার হইতে বিরত থাকা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বা সংস্কারকাজ নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী সমন্বিতভাবে করা, পর্যায়ক্রমে ইটের পরিবর্তে সিমেন্টের ব্লকের ব্যবহার বাড়ানো ইত্যাদি উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন