বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

১৪১ বৎসর বাঁচিবে মানুষ, তবে—

আপডেট : ০৫ মে ২০২৩, ০৪:৩৩

কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থের ‘প্রাণ’ নামক কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আকুতি জানাইয়াছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ ইহার পরের লাইনে তিনি লিখিয়াছেন, ‘এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে/ জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।’ কবিগুরুর ন্যায় প্রত্যেকেই এই ধরনের অভিলাষ পোষণ করিয়া থাকেন। বাঁচিতে কে না চাহে? মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়া কে না আঁতকাইয়া উঠে? পৃথিবীর মায়াজালে জড়াইয়া আমরা এই ধূলিধরায় দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করিবার কথা চিন্তা করি বটে, তথাপি প্রকৃতির নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাইয়া চিরজীবী হইবার বাসনা নিছক ধোঁয়াশা বই আর কিছুই নহে। আমরা কেবল দীর্ঘ জীবন তথা লম্বা আয়ু লাভের চিন্তা করিতে পারি—যদিও অবাস্তব চিন্তা ইহাও! শুনিতে অসম্ভব মনে হইলেও মানুষের অধিক দিন বাঁচিয়া থাকিবার আশাবাদ বাস্তবতার আলো দেখিতে চলিয়াছে! এই ধরনের আশার বাণী শুনাইয়াছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. ডেভিড ম্যাককার্থি। তিনি জানাইয়াছেন, পুরুষ ১৪১ বৎসর বয়স পর্যন্ত এবং নারী ১৩০ বৎসরের অধিক সময় পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকিতে পারিবেন। ‘আমরা দীর্ঘ আয়ু লাভ করিতে চলিয়াছি’—এই সংবাদে আপ্লুত হইবার অবকাশ রহিয়াছে বটে, তবে প্রশ্ন থাকিয়াই যায়—দখল, দূষণের পাশাপাশি আধুনিকতাবাদের দৌরাত্ম্য যেইরূপ রকেট গতিতে বাড়িয়া চলিয়াছে, তাহাতে আজিকার রুগ্ন পৃথিবী ভবিষ্যতে কতটা বসবাসের উপযোগী থাকিবে? কেমন হইবে সেই বিশ্বের জীবনপ্রবাহ?

অস্বীকার করিবার উপায় নাই, একবিংশ শতাব্দীর অতি-আধুনিক সভ্যতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পৃথিবী আজ ধুঁকিতেছে। শিল্পপ্রযুক্তিতে বিশ্ব যেই হারে আগাইয়া গিয়াছে, মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের বলি হইয়া ধরণি বসবাসের উপযোগিতাও হারাইয়াছে একই হারে! প্রকৃতির উপর এমন সকল অবিবেচনাপ্রসূত দমনপীড়ন চালাইয়া যাইতেছি আমরা, প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হইয়া আবহাওয়া-জলবায়ু বিগড়াইয়া গিয়াছে। বিশ্বের বৃহৎ নদনদী শীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল পুড়িতেছে। বহু জীব বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, জীবিত প্রাণিকুলের শ্বাসপ্রশ্বাসও আটকাইয়া যাইবার জোগাড়! প্রকৃতিকে আমরা নষ্ট করিতেছি অহর্নিশ। ব্যাপক হারে বন উজাড় তো করিতেছিই, ভূপৃষ্ঠকে করিয়া তুলিতেছি আবর্জনার ভাগাড়। ইহার সহিত যুদ্ধবিগ্রহের শিকার হইয়া প্রকৃতি যেইভাবে বিনষ্ট হইতেছে, তাহাই ‘কাল’ হইয়া উঠিবে আমাদের জন্য। যুদ্ধবাজ দেশসমূহ বোমা-বারুদের উৎকট গন্ধে প্রকৃতির নির্মল বাতাসকে ভারী করিয়া তুলিতেছে। তাহারা ভুলিয়াই গিয়াছে, যুদ্ধোন্মাদনার বশবর্তী হইয়া প্রকৃতির স্তরবিন্যাসের যেই ক্ষতি তাহারা করিতেছে, তাহা সারাইয়া তুলিতে লাগিয়া যাইবে যুগের পর যুগ। ঠিক এমন একটি অবস্থায় দাঁড়াইয়া দীর্ঘ আয়ু লাভের পরও জীবন কতটা সুন্দর হইতে পারে—এমন প্রশ্ন তোলা নিশ্চয় অবান্তর নহে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্ব বহু অগ্রগতি লাভ করিয়াছে—এই কথা যেমন সত্য, তেমনি এই আশঙ্কাও উড়াইয়া দিবার মতো নয় যে, প্রকৃতির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করিয়া কোনো সভ্যতার পক্ষেই টিকিয়া থাকা সম্ভব নহে।

২০২১ সালে মার্কিন জেনেটিক বিজ্ঞানী ডেভিড সিনক্লেয়ার বলিয়াছিলেন, ‘একটি ঔষধ আবিষ্কারের চেষ্টা চলিতেছে, যাহা মানুষের বার্ধক্যকে ঠেকাইয়া আয়ু বাড়াইয়া দিবে।’ আমরা জানি, পূর্বে মানুষ বহুকাল বাঁচিয়া থাকিতেন, দীর্ঘ জীবন ছিল তাহাদের; কিন্তু এইখানে একটি ‘কিন্তু’ রহিয়াছে; উহা হইল—সেই সময় প্রকৃতি ছিল সত্যিকার অর্থেই ‘প্রাকৃতিক’। বৃক্ষরাজি, জীবজগতের আধার ছিল ভূপৃষ্ঠ। অর্থাৎ, সুস্থ প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন ছিল সুন্দর, সুস্থ; কিন্তু বর্তমানে আমরা কী দেখিতেছি? গবেষকরা বলিতেছেন, ‘মানুষের আয়ু বাড়িতে বেশ সময় লাগিবে। তখন হয়তো পৃথিবীর চেহারাটাও একেবারে বদলাইয়া যাইবে।’ আসল সত্য এটিই! কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবট তথা ‘কৃত্রিমতা’ যেই হারে বাড়িতেছে সকল কিছুতেই, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে বলিতে হয়, ‘প্রকৃতি-পরিবেশ’, ‘প্রাকৃতিক’ শব্দগুলিই না হারাইয়া যায় অদূর ভবিষ্যতে! মূলত মনুষ্য জীবনকে দীর্ঘায়িত করিতে হইলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে ‘স্থিতিশীলতা’ ও ‘প্রকৃতির ছোঁয়া’। ইহা ছাড়া মানুষের জীবনকাল নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধির যত চেষ্টাই করা হউক না কেন, তাহা টিকসই হইবে না।

ইত্তেফাক/এমএএম