বাংলায় যাহাকে বলে ‘আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ’ হওয়া, তাহার সবচাইতে ভালো উদাহরণ হইল মাদক ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। কাজটি করিতে মাদক ব্যবসায়ীদের প্রায় সকলেই চিরকাল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সহিত যুক্ত হইয়া থাকে। এই সংক্রান্ত খবর ইতিমধ্যে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হইয়াছে যে, ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের অফিসে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি টাঙাইয়া তাহারা একধরনের ঢাল তৈরি করে। অতঃপর সেইখানে কিছু একটা ঘটিলে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু বা প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙা হইতেছে! কোনো কোনো অপরাধী এইভাবে নিজেদের রক্ষা করিবার কৌশল বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করিয়াছে। দুঃখজনকভাবে কোথাও কোথাও প্রশাসনও এমন একটি পর্যায়ে চলিয়া গিয়াছে, পয়সা খাইয়া তাহারাও বলিতেছে, ‘হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙা হইয়াছে।’ আসলে মাদক ব্যবসায়ীদের নিকট হইতে বিপুল কাঁচা টাকার লোভ সামলাইবার মতো ইস্পাতদৃঢ় আদর্শ অনেকের মধ্যেই নাই। এমনকি ইতিপূর্বে পুলিশেরই অনুসন্ধানে দেখা গিয়াছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের একটি অংশও এই ব্যবসায়ের টাকার লোভ সামলাইতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হইল—অপরাধীদের সবচাইতে বড় আশ্রয় কেন হইবে ক্ষমতাসীন দলের শামিয়ানা? আর যাহারা কর্তৃপক্ষ, তাহারাই-বা কেন অন্যের মুখে ঝাল খাইবেন? অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে গিয়া মাদক ব্যবসায়ীরা যাহা বলিল, তাহাকেই কেন মান্যতা দেওয়া হইবে? যাহাদের বাপ-দাদারা ছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, তাহাদের একটি অংশ মাদকের মতো অত্যন্ত ঘৃণিত ব্যবসায়ের সহিত যুক্ত হইয়া অনুপ্রবেশ করিয়াছে ক্ষমতাসীন দলে। গিরগিটির মতো তাহারা রং পালটাইয়াছে। গাছের পাতার রঙের সহিত নিজের রং মিলাইয়া লইবার অর্থ ইহা নহে যে, গিরগিটি ঐ গাছ আর তাহার পাতাকে ভালোবাসে। উহা হইল কেমোফ্লেজ, ছদ্মবেশ। এখন গাছ যদি মনে করে, ‘আমার গিরগিটি! কত ভালো গিরগিটি!’ তাহা হইলে উহা হইবে সত্যের অপলাপ।
সুতরাং বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি হইল গিরগিটিদের ঢাল। কমন সেন্স বলিয়া থাকে, স্বাধীনতার অর্ধশতক পর বঙ্গবন্ধুর ছবি কাহারো আক্রোশের শিকার হইতে পারে না। তাহা ছাড়া, আধুনিক এই প্রযুক্তির যুগে কোনো ছবিকে একদম আসলের মতো বিশ্বাসযোগ্য করিয়া ম্যানুপুলেট করা যায় খুব সহজে। বিজ্ঞান অনুযায়ী, কোনো ঘটনার সত্যতা খুঁজিতে কেস স্টাডি করিতে হয়। সুতরাং এই ধরনের ঘটনার কেস স্টাডি করিয়া সরেজমিনে গিয়া দেখা হউক—আসল ঘটনাটি কী? তাহার পর যাহারা দোষ করিয়াছে, তাহাদের অপরাধী অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেওয়া হউক। কিন্তু চিলে কান লইয়া গিয়াছে বলিয়া কানে হাত না দিয়াই চিলের পিছনে ছোটাটা কখনোই স্বাভাবিক কাজ নহে। সারা দেশের মানুষ সকল এলাকার সকল কাহিনী জানেন না, সকল সত্য বুঝিতেও পারেন না। কিন্তু যাহারা স্থানীয় লোক, তাহারা অন্তত বুঝিতে পারিবেন—কোনটা সত্য আর কোনটা বানোয়াট।
এই জনপদকে নান্দনিক বাগানতুল্য সুন্দর দেশ বানাইতে যাহারা বহু বৎসর ধরিয়া চেষ্টা করিতেছেন, দুঃখজনকভাবে সেই জমিনে এখন স্বাধীনতাবিরোধীরা বিষবৃক্ষের প্রচুর বীজ রোপণ করিতেছে। এই বীজগুলি যখন বড় গাছ হইবে, তখন এই জনপদকে কি সকলের জন্য বসবাস-উপযুক্ত একটি কল্যাণকর দেশ বানানো সম্ভব হইবে? সুতরাং যাহারা স্বাধীনতাবিরোধী বিষবৃক্ষ, তাহাদের বীজ ছড়াইবার পথ রুদ্ধ করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, আমরা যাহারা তৃতীয় বিশ্বের দেশে বসবাস করি, তাহাদের প্রতিটি পদক্ষেপই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজ যাহাদের তুচ্ছ মনে করিয়া ভ্রুক্ষেপ করা হইতেছে না, তাহারাই তলে তলে বারুদ জমাইয়া একসময় বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকিবে। তাহাদের দ্বারা হিতকর কাজ হইতে পারে না কখনো। কবি সুকান্ত যেমন বলিয়াছেন :‘জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।/ চলে যেতে হবে আমাদের।/ চলে যাব—তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/ এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ সুতরাং এই জঞ্জাল দূর করিবার জন্য সকলকেই প্রাণপাত করিতে হইবে। নচেৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা এই জনপদকে বসবাসোপযোগী করিয়া যাইতে পারিব না। উহা হইবে মারাত্মক ব্যর্থতা।