ঘূর্ণিঝড় মোখা আসিতেছে প্রবল অথবা সুপার সাইক্লোনের রূপ ধারণ করিয়া। ঘূর্ণিঝড়ের সহিত বাংলাদেশের, বিশেষ করিয়া উপকূলবর্তী অঞ্চলের আজন্ম পরিচিতি রহিয়াছে। একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় বিশেষ অবদান রাখিয়াছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। উহা ছিল ১৯৭০ সালের সুপার সাইক্লোন। হারপার কলিন্স হইতে প্রকাশিত স্কট কারনি এবং জ্যাসন মিকলিয়ানের লেখা ‘দ্য ভরটেক্স’ শিরোনামের গ্রন্থে এই বিষয়টি চমৎকারভাবে উঠিয়া আসিয়াছে। বইটির উপ-শিরোনাম—‘দ্য ট্রু স্টোরি অব হিস্টরিস ডেডলিয়েস্ট স্টম অ্যান্ড দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’। পাঁচ শত পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে লেখকদ্বয় প্রায় সাড়ে সাত শত সূত্র হইতে দেখাইয়াছেন যে, একটি প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় কীভাবে একটি দেশকে স্বাধীনতার পথে অনেকখানি আগাইয়া দেয়। বিবিসির রিপোর্টও বলিতেছে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঐ ঝড়ের আঘাতে তছনছ হইয়া গিয়াছিল বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়া গিয়াছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। জাতিসংঘের আওতাধীন বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা ২০১৭ সালে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করিয়াছে, যেইখানে ঐ ঘূর্ণিঝড়টিকে ‘সবচাইতে শক্তিশালী সাইক্লোন’ হিসাবে চিহ্নিত করিয়াছে।
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়টির তীব্রতা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার ধারণা করিতে পারে নাই। ফলে ১২ নভেম্বর বিকাল পর্যন্ত রেডিওতে কোনো সতর্কবাণীও প্রচার করা হয় নাই। শেষ সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের কথা প্রচার হইলেও জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস দিতে পারে নাই। আর মারাত্মক ক্ষতি হইয়াছিল ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের কারণেই। সর্বোচ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলীয় এলাকায় ১০ হইতে ৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হইয়াছিল। সেই সময় আবহাওয়া বিজ্ঞান আজিকার মতো এত বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে নাই। সুতরাং পূর্বাভাসে সমস্যা থাকিতেই পারে। কিন্তু প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের মহাবিপর্যয়ের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার নিদারুণ উদাসীনতা দেখাইয়াছিল। তাহাতে এই ভাবধারা প্রকাশ পাইয়াছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবন-মৃত্যু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিকট খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নহে। কারণ, তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঐ সাইক্লোনকে মোটেও গুরুত্ব দেন নাই। এমনকি তাহার সরকারের কোনো মন্ত্রী পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের পর উপদ্রুত এলাকায় যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। অনেকে মনে করেন, সেই সাইক্লোনটি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি বাঙালির অবিশ্বাসের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকিয়া দিয়াছিল। বঙ্গবন্ধু তখন বলিয়াছিলেন, ‘দুর্গত এলাকা আমি সফর করে এসেছি।... পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এখনো দুর্গত এলাকায় আসেননি। আমরা যে কত অসহায় এই একটা সাইক্লোন তা প্রমাণ করেছে।’ তখন নির্বাচনের বাকি মাত্র কয়েক সপ্তাহ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। সুতরাং ঘূর্ণিঝড়ও কখনো-কখনো অনেক বড় প্রভাবক হইয়া উঠিতে পারে। সত্তরের পর আরও অনেকগুলি সুপার সাইক্লোন হইয়াছে। সুপার সাইক্লোন না হইলেও সাধারণ ঘূর্ণিঝড় তো বাংলাদেশের জন্য খুবই সাধারণ ঘটনা।
বাংলাদেশ এখন ঘূর্ণিঝড়-জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। জলোচ্ছ্বাসের জন্য গত কয়েক দশক জুড়িয়া উপকূলীয় অঞ্চলে অসংখ্য সাইক্লোন শেল্টার কাম বিদ্যালয় তৈরি করা হইয়াছে। আরও একটি ভালো দিক হইল, ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও গতিপথের প্রায় নিখুঁত পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয় সপ্তাহখানেকই পূর্বেই। জানা গিয়াছে, ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ১ হাজার ৬০৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হইয়াছে। এই সকল আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ লক্ষাধিক মানুষ আশ্রয় লইতে পারিবেন। ইহা ছাড়া কক্সবাজার জেলায় ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৮ হাজার ৬০০ ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ২ হাজার ২০০ স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখা হইয়াছে। আর ৫৭৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হইয়াছে—যাহাতে সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষের ধারণক্ষমতা রহিয়াছে। পূর্বাভাস ঠিক থাকিলে শনিবার রাত হইতেই ঝড়ের প্রভাব পড়িবে উপকূলীয় এলাকায়। আশা করি, মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আসন্ন সকল দুর্যোগ যথাযথ ব্যবস্থাপনায় আমরা ভালোভাবে সামলাইতে পারিব।