গতকালের সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় মোখার অগ্রভাগ কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও মিয়ানমারের সিটুয়ে উপকূল দিয়া অতিক্রম করিয়াছে। এই ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রটি ছিল বাংলাদেশ উপকূল হইতে বেশ দূরে। ইহা কক্সবাজারকে স্পর্শ করিয়া মিয়ানমারের দিকে অগ্রসর হইলে ইহার সকল শক্তিও কেন্দ্রের দিকে পুঞ্জীভূত হয়। ইহা সুপার সাইক্লোনের রূপ ধারণ করিবার কথা ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশে তেমন বিধ্বংসী রূপ ধারণ করে নাই। তবে ইহাতে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনসহ কিছু কিছু এলাকার ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে। যদিও এই সম্পাদকীয় লিখা পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায় নাই। অন্যান্য বারের মতো এই বারও ঘূর্ণিঝড় উপলক্ষ্যে আমাদের সকল রকমের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল সন্তোষজনক। এই ঘূর্ণিঝড় যেখান হইতে আসিয়া যেখান দিয়া যাইবার কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই পথই অনুসরণ করিয়াছে। ফলে আল্লাহর অসীম রহমতে আমরা বড় ধরনের বিপর্যয় হইতে পরিত্রাণ লাভ করিয়াছি। এই জন্য আল্লাহর নিকট শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা জানাই।
স্বাধীনতা লাভের পর হইতে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ক্রমশই সফলতার পরিচয় দিয়া আসিতেছি। শুধু কক্সবাজার নহে, সমগ্র বাংলাদেশে বিশেষত উপকূলীয় এলাকায় আমরা মজবুত ও আধুনিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হইয়াছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেলও বটে। এই ক্ষেত্রে আমরা তৈরি করিয়াছি এক অনন্য উদাহরণ। বাংলাদেশ বিশ্বের নিকট বহু পূর্ব হইতেই একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসাবে পরিচিত। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও তিন-চতুর্থাংশ সীমানা জুড়িয়া পাহাড়-পর্বত থাকিবার কারণে এখানে মৌসুমি বৃষ্টিপাত অধিক হয়। ইহা যেমন আমাদের ফসল উত্পাদন ও জীবনযাপনের জন্য উপকারী, তেমনি বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, খরা, নদীভাঙন, ভূমিধস, পাহাড়ধস ইত্যাদি দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণও বটে। তবে শুধু এই সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগই নহে, সম্প্রতি আমরা করোনা মহামারি মোকাবিলায়ও সফলতার পরিচয় দিয়াছি, যেইখানে আমেরিকার মতো উন্নত দেশ করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাইয়াছে।
প্রকৃতপক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সাফল্যের পিছনে রহিয়াছে ১৯৭০ সালে বিশ্বের প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড় ভোলা সাইক্লোনের ভয়াবহ ঘটনার পর হইতে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ এবং দেশি-বিদেশি সহযোগিতা ও অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাইয়া সামনের দিকে অগ্রসর হইবার অনুপ্রেরণা লাভ। ভোলা সাইক্লোনে ৫ লক্ষাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটিয়াছিল। এই ঘটনার পর প্রশিক্ষিত তরুণ স্বেচ্ছাসেবক, রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিশ্রমে আমরা একটি অনুসরণীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হই। দুর্যোগকবলিত এলাকায় বৃদ্ধি পায় সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের গতি। বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয় স্কুল কাম সাইক্লোন সেন্টার। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতায় আমরা ঘুরিয়া দাঁড়াই। অবিশ্বাস্য হইলেও সত্য, বর্তমান সরকারের আমলে এই সকল এলাকায় বহুতলবিশিষ্ট স্কুল-কলেজ নির্মিত হইয়াছে, যাহা দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহূত হইতেছে। ভূমিহীন মানুষের জন্য পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ, গণমাধ্যমের বিকাশ এবং সার্বিকভাবে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক বনায়ন ত্বরান্বিত হওয়ায় দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বাড়িয়াছে। ভোলাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় এখন নির্মিত হইয়াছে ব্লকের টেকসই বাঁধ।
জানা মতে, গত ১০০ বত্সরে বাংলাদেশে ৫৩টি বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় দেখা দিয়াছে। ১৯৯৭ ও ২০০৭ সালে যে দুইটি বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তাহার গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৫ ও ২০০ কিলোমিটার; কিন্তু মোট মৃত্যু ছিল যথাক্রমে ১২৬ ও ৩ হাজার ৪০৬ জন। ২০২০ সালে আম্ফান আঘাত হানিলে ২৬ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন; কিন্তু ইহাতে মৃত্যু হইয়াছিল ২৬ জন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উন্নতি ও সচেতনতার কারণেই আজ জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। আজ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়িয়া গিয়াছে। অথচ এই সকল দেশের মানুষ এই সকল দুর্যোগ মোকাবিলায় তেমন অভ্যস্ত নহেন। তাহারা এখন বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হইতে শিক্ষালাভ করিতেছেন। এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যেইভাবে ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে তদারক করিয়াছেন, তাহা সকল মহলে প্রশংসিত হইয়াছে। আশা করি, যেইটুকু ক্ষয়ক্ষতি হইয়াছে, তাহা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সুরাহা করা হইবে।