শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে জাপানই প্রথম, যারা স্বাধীনতা লাভের দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ভিত রচিত হয় ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাপান সফরের মধ্য দিয়ে। অবকাঠামো, কৃষি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচিত হয় এ সফরে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু যে নবতর অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন তারই রক্তের সুযোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন। আজকের বাস্তবতা হলো—ওডিএ ঋণ প্যাকেজে জাপান বাংলাদেশকে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি সহজশর্তে ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। দ্বিমুখী দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রথম বারের মতো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ঢাকায় মাস র্যাপিড ট্রানজিট ট্রেনলাইন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং আড়াইহাজারের একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ জাপান বাংলাদেশের কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিগ-বি ইনিশিয়েটিভে পালটে যাচ্ছে মাতারবাড়ীর চিত্র। মাতারবাড়ী-ই হচ্ছে অর্থনীতির গেম চেঞ্জার। এমনি এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের (২৫-২৮ এপ্রিল ২০২৩) জন্য জাপান সফর করেন। প্রধানমন্ত্রীর একজন সফরসঙ্গী হিসেবে এই চার দিনে দুই দেশের মধ্যে যা যা ঘটেছে তার প্রায় সবই আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক কৌশলগত মাত্রায় পৌঁছায়। অর্থাৎ দুটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের আদান-প্রদান ও সহযোগিতার যত রকমের ক্ষেত্র রয়েছে তার সবকিছু নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থে দুই দেশ এক সঙ্গে কাজ করবে। ২৬ এপ্রিল ২০২৩ বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে আটটি চুক্তি ও সহযোগিতা স্মারক এবং পরবর্তী সময় বেসরকারি পর্যায়ে বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) আরো ১১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তবে আটটি চুক্তি ও সহযোগিতা স্মারকের মধ্যে একটি হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-সংক্রান্ত সহযোগিতা স্মারক, যাতে আমি নিজে স্বাক্ষর করেছি। প্রসঙ্গক্রমে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের সূচনা এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তা অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়া নিয়ে সংক্ষেপে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলেও এ নিবন্ধের আলোচনা আবর্তিত হয়েছে মূলত বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি-সংক্রান্ত সহযোগিতা স্মারক নিয়ে। ২০৪১ সাল নাগাদ একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই স্মারক কতোটা সহায়ক হবে সে সব বিষয় নিয়ে।
প্রথমেই বলে রাখি, সহযোগিতা স্মারকটি প্রণীত হয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের দীর্ঘমেয়াদি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। এতে বলা হয়েছে, উদ্ভাবন, গবেষণা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ডিজিটাল অর্থনীতি, ডিজিটাল লিটারেসি, সাইবার সিকিউরিটি, তথ্য আদান-প্রদান, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশ একযোগে কাজ করবে। প্রসঙ্গত সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরের আগেই আইসিটি বিভাগ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহযোগিতায় স্মার্ট বাংলাদেশ : আইসিটি ২০৪১ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করেছে। এ মাস্টারপ্ল্যান অনুসারে, স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট গভর্নমেন্ট, স্মার্ট অর্থনীতি এবং স্মার্ট সোসাইটি—এই চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মসূচি গ্রহণ এবং বেশকিছু উদ্যোগের বাস্তবায়নও শুরু করেছে সরকার। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, সহযোগিতা স্মারকে সহযোগিতার যে সব ক্ষেত্রের উল্লেখ করা হয়েছে তার সবই স্মার্ট বাংলাদেশের চার স্তম্ভে প্রস্তাবিত কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা স্মারক চুক্তির ভবিষ্যৎ ও অর্জন নিয়ে। এ বিষয়ে আলোচনার আগে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয় কাটিয়ে জাপান কীভাবে বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে অন্যতম শীর্ষ দেশ হলো সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই। জাপান সফরকালে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের বাইরে রাষ্ট্রীয় নেতৃবর্গ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ-আলোচনায় উঠে আসে জাপানের বিস্ময়কর উত্থানের নানা তথ্য। আমরা জানি যে, প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বছর (সময়কাল ৭০০০-১০০০ খ্রিষ্টপূর্ব পর্যন্ত) আগে প্রথম কৃষি বিপ্লবের আবির্ভাব হয়। দ্বিতীয় কৃষি বিপ্লবের সময়কাল ছিল ১৯৩০-১৯৬০ সাল পর্যন্ত। তবে ১৮০০ শতক থেকে সনাতনী কৃষি পদ্ধতির রূপান্তর শুরু হয় ব্রিটেনে। জাপানে তা শুরু হয় মেইজি যুগে (১৮৬৪-১৯৪৫)। ১৯৩০ সালে দেশটিতে ভার্টিক্যাল রাইস পেলিশিং মেশিনের উদ্ভাবন কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ করে। সময়ের পথপরিক্রমায় উচ্চ জনসংখ্যা, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতি, সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদ, অপর্যাপ্ত শিক্ষাগত সুযোগের মতো পাহাড়সম সমস্যার মোকাবিলা করে জাপান বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তিতে শীর্ষ দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়। জাপানের নেতৃবৃন্দের মতে, শিল্প প্রযুক্তির উন্নয়ন, জাতীয় নীতির প্রভাব, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং যথাযথ স্থানে তাদের প্রতিস্থাপন এই অগ্রগতির নেপথ্যে বড় ভূমিকা পালন করে। তারা শিল্পকারখানাগুলোতে ব্যাপকহারে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), রোবটিক্স, থ্রিডি প্রিন্টিং, ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে আরো বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। বর্তমানে দেশটি অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহার করে মানবকেন্দ্রিক সমাজের রূপান্তর ঘটাতে চাইছে, যাকে বলা হচ্ছে সোসাইটি ফাইভ ডট ও (৫.০)। মানব সভ্যতার আদিকালে শিকারি যুগ, কৃষি যুগ, শিল্প যুগ এবং তথ্যযুগ পেরিয়ে সুপার স্মার্ট যুগে জন্মহার, বয়স্ক জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দূষণের মতো সমস্যা প্রযুক্তি দিয়ে মোকাবিলার পাশাপাশি কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে সমাজকে রূপান্তর করার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে জাপান। তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগামী এমন একটি দেশের সঙ্গে আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসংক্রান্ত সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি। আশার কথা, জাপানের নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশের সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২৬ এপ্রিল টোকিওর আসাকা প্যালেসে জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জেট্রো) চেয়ারম্যান ও সিইও নরিহিকো ইশিগুরুর সঙ্গে বৈঠকে আমি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের রূপরেখার পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, মাইক্রেচিপস ডিজাইন, ন্যানো প্রযুক্তি ও সাইবার সিকিউরিটির বিষয় তুলে ধরি। ইতিমধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য স্মার্ট ডিজিটাল লিডারশিপ একাডেমি গড়ে তোলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে রিসার্স অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার (আরআইসি) ও ইনকিউবেশন সেন্টার, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তির উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা ও যুগোপযোগী পলিসি প্রণয়নে সহযোগিতার জন্য সেন্টার ফর ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে অবহিত করা হয়।
জাপানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রসঙ্গ। বিশেষ করে তৃতীয় শিল্পবিপ্লব থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পার্থক্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে প্রধান তিনটি বিবেচ্য বিষয় সম্পর্কে। প্রথমটি হলো গতি, দ্বিতীয়টি সুযোগ ও সম্ভাবনা; এবং তৃতীয়টি পদ্ধতিগত প্রভাব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে প্রায় সবকিছুতেই দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তন, সম্ভাবনা ও সুযোগের ব্যবহার এবং পদ্ধতিগত প্রভাবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জাপান অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়। ফলে দেশটিতে গড়ে উঠেছে রোবট শিল্প। কৃষি, শিল্প, শিক্ষাসহ প্রায় সব খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর নানা সমাধান। আমরা জাপানের নেতৃবৃন্দকে জানিয়েছি ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : আইসিটি ২০৪১ মাস্টার প্ল্যান’-এ ৪০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বাণিজ্য, পরিবহন, পরিবেশ, শক্তি ও সম্পদ, অবকাঠামো, বাণিজ্য, গভর্ন্যান্স, আর্থিক লেনদেন, সাপ্লাই চেইন, নিরাপত্তা, এন্টারপ্রেনিউরশিপ, কমিউনিটির মতো খাতগুলো অধিকতর দক্ষতা বা স্মার্টলি পরিচালনার জন্য আগামীতে যে সব কর্মসূচি আমরা গ্রহণ করতে যাচ্ছি তাতে জাপানের সহযোগিতা চাই।
আমাদের সামনে রয়েছে রূপকল্প ২০৪১ ও স্মার্ট বাংলাদেশ। রূপকল্প ২০৪১-এর মূল লক্ষ্য উন্নত দেশ বিনির্মাণ। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ অনুসারে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে বর্তমান মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার এবং যা হবে ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। দ্বিতীয়টি, বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, যেখানে দারিদ্র্যের হার হবে সুদূর অতীতের ঘটনা। প্রেক্ষিত পরিকল্পনার এসব লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম অনুঘটক হতে পারে স্মার্ট বাংলাদেশ। এসব বিবেচনায় নিয়ে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ গুরুত্বপূর্ণ সব খাতে অগ্রসর প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের ব্যবহার করে সরকার ২০৪১ সাল নাগাদ জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে আইসিটি খাতের অবদান কমপক্ষে ২০ শতাংশ নিশ্চিত করতে চায়। এই লক্ষ্য অর্জন দ্রুততর করতে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সহযোগিতা স্মারক একটি মাইলফলক অর্জন, যা শুধু স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রাকে মসৃণ করবে না, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : এমপি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী