বৃহস্পতিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ক্ষুদ্রঋণের নামে প্রতারণার ফাঁদ 

‘র‌্যাপিড ক্যাশ’র নেতৃত্বে দুই চীনা নাগরিক, টার্গেট তিন দেশ

আপডেট : ১৭ মে ২০২৩, ১৮:৫৭

‘র‌্যাপিড ক্যাশ’ নামে অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে সহজে লোন দেওয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতে পরে হাতিয়ে নেওয়া হয় গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য। এমন এক চক্রের মূলহোতা দুই চীনা নাগরিক। তারা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে থেকে এই প্রতারণা চক্রটি চালিয়ে আসছে।

বুধবার (১৭ মে) দুপুরে রাজধানীর বারিধারায় অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিউ) প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির সাইবার ক্রাইম উইংয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) ফারহানা ইয়াসমিন।

তিনি বলেন, সম্প্রতি রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় এক ভুক্তভোগী এই চক্রের হাতে প্রতারিত হয়ে অভিযোগ করেন। এর ধারাবাহিকতায় মামলা তদন্তে চক্রটির সন্ধান পায় এটিউ।

অ্যাপের মাধ্যমে ৫০০ থেকে কয়েক হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে সেই টাকা আদায় করা হয় উচ্চ সুদে। টাকা দিতে অস্বীকার করলে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ ও আপত্তিকর ছবি বিভিন্ন জনকে পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। এভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

মঙ্গলবার (১৬ মে) রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে কল সেন্টারটির পরিচালক মহিউদ্দিন মাহিসহ ২৬ জনকে আটক করেছে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিউ) সাইবার ক্রাইম উইং। তবে এই চক্রের মাস্টারমাইন্ড দুই চীনা নাগরিককে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এসময় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু কম্পিউটার ও ল্যাপটপ জব্দ করা হয়।

ফারহানা ইয়াসমিন জানান, সাধারণ মানুষ ঋণ নেওয়ার জন্য অ্যাপটি মোবাইলে ডাউনলোড করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারীর সব কন্টাক্ট নম্বর, গ্যালারির তথ্য, ছবি, ভিডিওসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করা মহিউদ্দিন মাহি চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পড়াশোনা করেছ। সে চীনা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। এই সুযোগে তারা এই প্রতারণাটি করে আসছিল। বাংলাদেশে বসে তারা প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকদেরও একইভাবে লোন দিয়ে প্রতারণা করতো। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদায় করতো।

মহিউদ্দিন মাহি

ফারহানা আরও জানান, সহজে লোন দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলা হতো। এরপর মোবাইলের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলার নামে ভোটার আইডি ও ছবি নিতো। গ্রাহকরা এই কাজগুলো করার সময়ে চক্রটি কৌশলে মোবাইলের কল লিস্ট, গ্যালারির ছবি, ভিডিওসহ সব তথ্য হাতিয়ে নিত। এরপর লোন দেওয়ার পরে উচ্চ সুদে আদায় শুরু করতো। কেউ দিতে আপত্তি জানালেই তাকে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের হুমকি দিতো। এই অ্যাপটি বানিয়েছে চীনারা। তারা এটাকে এভাবেই বানিয়েছে যে ডাউনলোড করলেই সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানে আমরা দেখতে পাই একটি বাসার ভেতরে গোপনে তারা এ কাজ করছে। অফিসে কাজ করা তরুণ-তরুণীরা হিন্দি ও উর্দু ভাষায় ভারতীয় ও পাকিস্তানি নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলছে। ভারত ও পাকিস্তানে একই অ্যাপ ভিন্ন নামে লোন দিচ্ছে। একইভাবে তাদের সঙ্গেও লোন দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। ৫০০ টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে। এর বিপরীতে তারা ২০ থেকে ২২ লাখ টাকাও আদায় করেছে।’

চক্রটি প্রতিটি কর্মীকে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেয়। পাশাপাশি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারলে বোনাস দেওয়া হতো। এর মাধ্যমে কর্মীরা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পেতেন। এই চক্রের এমন কল সেন্টার আরও আছে বলে ধারণা এটিইউ’র।  

প্রতারণা চক্রের সদস্যদের এটিউয়ের গাড়িতে তোলা হচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, মাহি উচ্চশিক্ষিত। সে চীনা ভাষায় দক্ষ ও ক্রিপ্টো কারেন্সি ব্যবসা সম্পর্কে জানে। পাশাপাশি সে কথায় অনেক পটু। কীভাবে মানুষকে ভয় দেখাতে হবে, কী বললে টাকা আদায় করা যাবে সে সব জানে। এমনকি তার কর্মীদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করতো গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে। টাকা আদায় করতে না পারলে তাদের বের করে দিতো।

সহজে ঋণ দেওয়ার কথা বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতো চক্রটি। মানুষ সহজে টাকা পাওয়ার জন্য তাদের ফাঁদে পা দিতো। এরপর আর চাইলেও বের হতে পারতো না। কোনও কোনও গ্রাহক বাড়িঘর বিক্রি করেও টাকা দিয়েছে। চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা আদায় করতো। দেশে বিকাশ ও নগদ ব্যবহার করতো। ভারত ও পাকিস্তানেও একইভাবে আদায় করতো। তারা যোগাযোগের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম ব্যবহার করতো। তারা একটি নম্বর ব্যবহার শেষে বন্ধ করে দিতো। এমনকি কোনও গ্রাহককে আপত্তিকর ছবি পাঠিয়ে নিজেরা ডিলিট করে দিতো। কোনও আপত্তিকর তথ্য নিজেদের কম্পিউটারে রাখতো না। এসব ছবি বানানোর জন্য আলাদা আরেকটি দল রয়েছে। তারা দেওয়ার পরে সব ডিলিট করে দিতো।

 

 

 

ইত্তেফাক/এসজেড