সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের প্রভাব ও প্রবাসীদের অধিকার 

আপডেট : ১৮ মে ২০২৩, ০০:১১

সম্প্রতি এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, চলতি মে মাসের প্রথম ১২ দিনে ৭৭৪ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এটিকে শুধু এই মাসের নিরিখে মাপলে ভুল হবে। গত এপ্রিলেও মোট ১.৬৮ বিলিয়ন ডলার দেশের বাজারে প্রবেশ করে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় হিসাবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬.৪২ বিলিয়ন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট ১৮.২ বিলিয়ন ডলার পাঠান আমাদের প্রবাসীগণ। 

গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। আর এর কৃতিত্ব অনেকটাই বর্তায় প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত আয়ের ওপর। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিস্ট্যান্স যে শুধু তাদের পরিবারের মঙ্গল বয়ে আনছে তা নয়, বরং দেশের সার্বিক উন্নতিতেও এটি বেশ ইতিবাচক প্রভাব রাখছে। দেশের মোট আয়ের একটি বড় অংশ আসছে মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের অন্যান্য অংশে কর্মরত বাংলাদেশিদের হাত ধরে। রিতসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক মুনিম কুমার বড়াই তার এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে রেমিট্যান্সের অংশ ছিল ৫.৫২ শতাংশ। 

গত শতকের আশির দশক থেকেই বাংলাদেশ শ্রম রপ্তানি করতে শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বহু অর্থনীতিবিদের মতে, আগে তুলনামূলক অদক্ষ যেসব শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে গেছেন, তাদের কাজ তেমন প্রযুক্তিনির্ভর ছিল না। তাই তাদের চাকরির ক্ষেত্রে তেমন বেগ পেতে হয়নি। তাছাড়া তাদের শ্রমও ছিল তুলনামূলক সস্তা। যার ফলে এ অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ বাইরে গিয়ে কাজের সুযোগ পায়। অধ্যাপক বড়াই আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার দেওয়া তথ্য মোতাবেক, প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। 

মূলত গ্রামাঞ্চল থেকে বিদেশে কাজ কর?তে যাওয়ার ঝোঁক বেশি দেখা যায়। ফলে সেই শ্রমিকেরা যখন রেমিট্যান্স পাঠান, সেটি মূলত গ্রামের উন্নয়নেই ব্যয় হয়। বাংলাদেশের বহু গ্রামের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেগুলো মূলত প্রবাসীদের আয়ে গড়ে উঠেছে এবং উন্নতি লাভ করেছে। এই রেমিট্যান্সের ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ভারী হচ্ছে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে—এ তো সহজেই বোধগম্য। কিন্তু এর বাইরেও রেমিট্যান্সের বেশ কিছু পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। একজন শ্রমিক যখন দেশের বাইরে থেকে তার পরিবারের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন, তখন সেটি তার পরিবারের একাধিক সদস্যের হাতে ক্রয়ক্ষমতা এনে দিচ্ছে। তারা তখন নানাবিধ পণ্য কিনে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। এর ফলে একদিকে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেমন হ্রাস পাচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে উন্নতি ঘটছে মানুষের জীবনমানের।  

প্রবাসী আয় দেশের বহু মানুষের হাতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগেরও সুযোগ করে দিচ্ছে। যেমন, অনেকেই প্রবাসে অর্জিত আয় দ্বারা নিজে কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলছেন। এতে করে সেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনেও রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অর্থাৎ, প্রবাসী আয় বহুবিধ পরোক্ষ উপায়েও ব্যক্তিগত, গ্রামীণ ও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। 

রাষ্ট্রীয়ভাবে কারিগরি নানা সহায়তার ফলে বর্তমানে বহু দক্ষ শ্রমিক কাজের সূত্রে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন। যত বেশি দক্ষ শ্রমিক বাংলাদেশ রপ্তানি করতে পারবে, রেমিট্যান্সের হারও ততই বাড়বে। সেইসঙ্গে রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহারও যতদূর সম্ভব কমাতে হবে। বাংলাদেশি বহু শ্রমিক, বিশেষত নারীরা, বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হন। আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য যারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করছেন, তাদের ভালো থাকার বিষয়টিও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। তাদের বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা দিতে হবে। তাদের সর্বপ্রকার অধিকার রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে পালন করতে হবে আরো সোচ্চার ভূমিকা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন