মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

থাইল্যান্ডের পরবর্তী গন্তব্য কোন দিকে?

আপডেট : ১৯ মে ২০২৩, ০৬:৩০

 

 

থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৪ মের নির্বাচন সবাইকে বিস্মিত করেছে। সব হিসাবনিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছেন থাই ভোটাররা। ‘বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হতে চলেছেন থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বাধীন দল ফেউ থাই পার্টি’—বুথফেরত জরিপে এমন ভবিতব্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত ফলাফলে বিপুলসংখ্যক আসনে এগিয়ে থাকতে দেখা যায় মুভ ফরোয়ার্ড পার্টিকে (এমএফপি)। মাত্র বছর তিনেক আগে আত্মপ্রকাশ করা ছোট রাজনৈতিক দল এমএফপি স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই ভোটারদের মন জয় করে সবাইকে যে এভাবে চমকে দেবে, এমন চিন্তা ছিল কল্পনারও বাইরে! খুব কম লোকই ধারণা করেছিলেন, এতটা দ্রুত থাইল্যান্ডের শীর্ষপর্যায়ে পৌঁছে যাবে এমএফপি! যদিও দিন শেষে ঘটেছে সেটাই।

এবারের নির্বাচনে থাই ভোটাররা যে যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন, তা সংস্কারপন্থী দল এমএফপিকে বসাতে চলেছে থাইল্যান্ডের চালকের আসনে। ৪২ বছর বয়সী পিটা লিমজারোয়েনরাতের নেতৃত্বে গণতন্ত্র-পন্থি ফেউ থাই এবং আরও পাঁচটি ছোট দল নিয়ে জোট সরকার গঠন করতে চাইছে এমএফপি। পিটা নিজেকে ‘থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন ইতিমধ্যে। পিটার ঘোষণার মধ্য দিয়ে থাই রাজনৈতিক অঙ্গন নতুন সাজে সজ্জিত হবে বলে আভাস দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরাও।

মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচনের ফলাফল থাইল্যান্ডের জনগণের ‘মত’ পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এর মধ্য দিয়ে বস্তুত এটা প্রমাণিত হয়েছে, জনজীবনকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জনতা আস্থা রাখছে হার্ভার্ড ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াশোনা করা ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া এমএফপি দলের উদীয়মান নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাতের ওপর। ব্যাংককের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক থিতিনান পংসুধিরাকের মতো অনেক বিশ্লেষকের বিশ্বাস, তরুণ ভোটারদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় ৪২ বছর বয়সী আদর্শবাদী সংস্কারপন্থী নেতা পিটার হাত ধরে থাই রাজনীতি ‘এক নতুন যুগে’ প্রবেশ করবে। এর কারণ, এমএফপি তারুণ্যনির্ভর এমন এক উদীয়মান আদর্শবাদী দল, যা থাইল্যান্ডকে শতাব্দীর সেরা অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে থাই জনগণের কাছে। ক্রমাগতভাবে কঠিন হয়ে ওঠা থাইল্যান্ডের রাজনীতি এক্ষেত্রে এমএফপির সামনে যে নানামুখী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে, সে কথা বলাই বাহুল্য। যা হোক, বিশ্ব ও থাইল্যান্ডের বর্তমান বাস্তবতার মধ্যে শেষ পর্যন্ত যদি এমএফপি সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়, তবে কোন কোন বিষয় নতুন এই দলের সামনে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে দাঁড়াবে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক—

ধারা ১১২ ও একগুঁয়ে সিনেটর

এমএফপি বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের আখ্যান শুনিয়ে নির্বাচনে ভালো ফল অর্জন করেছে। নিরস্ত্রীকরণ, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুরক্ষা, একচেটিয়া ব্যবসার লাগাম টানা ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো ছিল তরুণ দল এমএফপির নির্বাচনি ইশতেহারের উল্লেখযোগ্য পয়েন্ট। বলে রাখা দরকার, থাই ফৌজদারি কোডের ‘১১২ ধারা’ সংস্কারের চিন্তা করা রাজকীয় মানহানির শামিল। কেননা, এটা এমন এক আইন, যা অতি সমৃদ্ধ রাজতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে পরিগণিত। এই অবস্থায় ‘থাই সমাজে পরিবর্তন অপরিহার্য’—এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপের বাস্তবায়ন এমএফপির জন্য বেশ কঠিন হবে নিঃসন্দেহে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের গবেষণায়ও এ ধরনের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।

থাইল্যান্ডের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের (রাজতন্ত্র) সমালোচনা করে ‘১১২ ধারা’ সংস্কারের জন্য এমএফপি যে প্রতিশ্রুতির কথা বলে আসছে, তার জন্য ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে থাইল্যান্ডে। অর্থাৎ, এমএফপির জন্য এই আইনি ধারা পরিবর্তনের চেষ্টাকে ‘রেড লাইন’ অতিক্রম করার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এমএফপি জোট নেতা পিটাকে এক্ষেত্রে পাড়ি দিতে হবে ‘কঠিন পথ’।

পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পিটার প্রয়োজন ৩৭৬ সিটের, যেখানে তার হাতে আছে ৩১০ সিট। এক্ষেত্রে জোটের মাধ্যমে উতরে গিয়ে সরকার গঠন করবেন পিটা। তবে সমস্যা দূর হবে না এর পরও। ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলদের বাছাই করা ২৫০ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত সিনেট অন্য কোনো দল ও জোটের সঙ্গে হাত মেলালে পিটার কাজ বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে।

থাই রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কেন ম্যাথিস লোহাতেপানন্ট মনে করেন, ‘এরই মধ্যে একাধিক সিনেটর টানাপড়েনে ভুগছেন। কেউ কেউ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন পিটার থেকে। তারা বলেছেন, ‘রাজকীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে হাত দেওয়ার কথা বলার কারণে আমরা পিটাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন দিতে ইচ্ছুক নই।’ অর্থাৎ, ‘ধারা ১১২’কে আলোর মুখ দেখাতে চাইলে পিটাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। ম্যাথিস যেমনটা বলেছেন, ‘এটা এখনো স্পষ্ট নয়, এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পিটা কোন পথে হাঁটবেন?’

আইনি ঝামেলা, নাকি আরেকটি অভ্যুত্থান?

পিটা সামনের দিনে আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। ভোট চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হবে দুই মাস পর। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন কিংবা সিনেটের মাধ্যমে পিটার আইনি জালে জড়িয়ে পড়লে হিসাবনিকাশ কোন দিকে মোড় নেবে, তা স্পষ্ট করে বলাটা মুশকিল। প্রার্থীদের ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করার ঘটনাও ঘটতে পারে। ২০১৯-এর নির্বাচনেও দেখা গিয়েছিল এ ধরনের দৃষ্টান্ত! এমনকি প্রথম সারির নেতাদের এক দশকের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার ঘটনাও ঘটে সে সময়।

ইতিমধ্যে পিটার মাথার ওপর একই ধরনের আইনি অভিযোগ ঝুলছে। নির্বাচনের আগে একজন রক্ষণশীল আইনপ্রণেতা নির্বাচন কমিশনে যে অভিযোগ ঠুকে দিয়েছিলেন, তা পিটার জন্য ডেকে আনতে পারে বড় ধরনের বিপদ। প্রয়াত পিতার মালিকানাধীন মিডিয়া ব্যবসার শেয়ারের মালিকানা নিয়ে পিটার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন ঐ আইনজীবী। থাই রাজনীতিবিদদের মিডিয়া কোম্পানিতে অংশীদারিত্ব নিষিদ্ধ বিধায় মিডিয়ায় মালিকানা থাকার অভিযোগ ভোগাতে পারে পিটাকে!

তাছাড়া নতুন করে অভ্যুত্থানের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকেরা। থাইল্যান্ড এমন এক দেশ, যেখানে গত শতাব্দীতে ডজনখানেক সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। বহুবার দেশ যায় সামরিক শক্তির দখলে। এ অবস্থায় দীর্ঘ মেয়াদে ভুগতে থাকা অস্থিরতার মধ্যে প্রতিবাদ, ক্ষোভ-বিক্ষোভের পিঠে চড়ে থাইভূমিতে আরেকটি অভ্যুত্থান মাথাচাড়া দিলে তাকে ‘অস্বাভাবিক ও বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না। তবে আশার কথা, বর্তমান বাস্তবতায় সেই আশঙ্কা অনেকটাই কম। যেমনটা মনে করেন থাইল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো বুনওয়ারা সুমানো—‘অভ্যুত্থানের আশঙ্কা সব সময়ই থেকে যাচ্ছে বটে, কিন্তু আমি মনে করি না যে, আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

এ বিষয়ে প্রায় সবারই এক কথা, ‘এবারের পাবলিক ভোটে জনগণের রায়কে তোয়াক্কা না করার চিন্তা করা হলে তা থাইল্যান্ডকে ঠেলে দেবে গভীর অন্ধকারের দিকে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় এমন যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করা সামরিক ও রাজতন্ত্রসহ থাইল্যান্ডের রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতকে ক্ষুণ্ণ করবে ব্যাপকভাবে। এমতাবস্থায় সর্বোত্তম কাজ হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়. সে বিষয়ে চিন্তা করা।’

অর্থনৈতিক নীতি

শুরু থেকেই মজুরি ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে এমএফপি। থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে ‘একচেটিয়া’ সংস্কৃতিকে মোকাবিলা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়ে রেখেছেন পিটা। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হবে তাকে। বলা হচ্ছে, ‘স্বল্প মেয়াদে মুভ ফরোয়ার্ডের নীতিগুলো থেকে সুবিধা পাওয়া গেলেও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখে তা ঠিকঠাক কাজ করবে বলে মনে হয় না।’ এক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন এবং আরো উৎপাদনশীল ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিতের বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে।

চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমার ফ্যাক্টর

পিটা বলেছেন, চলমান বৈদেশিক নীতির আলোকে ‘নতুন দৃষ্টিভঙ্গি’ নিয়ে চলবে আগামীর থাইল্যান্ড। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো পক্ষকে সমর্থনের প্রশ্নে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে। আবার পিটা প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ককে ঢেলে সাজানোর যে ছকের কথা বলেছেন, তা নিয়েও উভয় দেশকে বহু সমীকরণের বিষয় মাথায় রেখে চলতে হবে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে থাইল্যান্ড আগামী দিনে কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাবে, তার দিকেই চোখ এই অঞ্চলসহ সারা বিশ্বের মানুষের।

লেখক: সিএনএন, এনবিসি নিউজ, এজেন্সি ফ্রান্স-প্রেসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দায়িত্ব পালন করা ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান সুজন

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন