মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

‘ভরণপোষণ’ বাবা-মায়ের আইনি অধিকার

আপডেট : ২০ মে ২০২৩, ০৭:৩০

হাজার সম্পর্কের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্কের বন্ধন হয়ে ওঠে সন্তান ও  বাবা-মায়ের মধ্যে। বাবা-মা ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব কল্পনাতীত, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের জীবনের সবচেয়ে বৃহত অংশজুড়ে থাকা বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দিলে সেই অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তাঁর ইচ্ছেমতো বান্দার সব গুনাহ মাফ করেছেন। কিন্তু বাবা-মায়ের অবাধ্যতার গুনাহ মাফ করেন না বরং এই গুনাহগারকে পার্থিব জীবনে মৃত্যুর আগেই শাস্তি দিয়ে থাকেন।’ 

সভ্যতার ক্রমবিকাশে সমাজের অনেক বৃদ্ধ বাবা-মায়ের অবস্থা হয়ে পড়েছে কষ্টকর। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়ে। যা উচিত নয় বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত সন্তানের দ্বারা মা-বাবারা বেশি অবহেলিত। বর্তমান যুগে দেখা যায়, উচ্চশিক্ষিত সন্তান, ভালো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হলেও বাবা-মাকে ভরণপোষণ আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে।

বর্তমানে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বাবা-মায়ের ভরণপোষণ দেওয়া সন্তানের জন্য বাধ্যতামূলক। অমান্য করলে সন্তানদের আইনের আওতায় আনা হবে। অবহেলিত বাবা-মায়ের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে এবং সন্তানের কাছ থেকে ভরণপোষণ আদায়ে বাবা-মায়ের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে সরকার ২০১৩ সালে বাবা-মায়ের ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর আইনটি জাতীয় সংসদে পাশ হয়। আইনের ২ ধারা, জন্মদাতা পিতা-মাতা এই আইনের ৩ ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে—পিতা-মাতার ভরণপোষণ সন্তান নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি একাধিক সন্তান থাকলে আলোচনা করে নিশ্চিত করবে। কোনো সন্তান পিতা-মাতাকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস বা আলাদাভাবে অন্য কোথাও বসবাসের জন্য বাধ্য করতে পারবে না। প্রত্যেক সন্তানকে পিতা-মাতার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে। যদি সন্তানের স্ত্রী, পুত্রকন্যা বা কোনো নিকটাত্মীয় ব্যক্তি পিতা-মাতার ভরণপোষণে বাধা প্রদান করে তবে সে ব্যাক্তিকে  আইনের তত্ত্বাবধানে আনা হবে। ৪ ধারা পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদি, নানা-নানী থাকলে পিতা-মাতার অবর্তমানে তাদের ৩ ধারা অনুযায়ী সেবাদানে বাধ্য, যদি কেউ এই আইন অমান্য করে, তবে তাকে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তিন মাসের জেলের বিধান রয়েছে। পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইনের ৩-এর (০৭) অনুযায়ী কোনো পিতা-মাতা কিংবা উভয়ে, সন্তানের সঙ্গে বসবাস না করে, পৃথকভাবে বসবাস করলে, সেই ক্ষেত্রে উক্ত পিতা বা মাতার প্রত্যেক সন্তান তাদের দৈনন্দিন আয়-রোজগার বা মাসিক বা বাৎসরিক আয় হতে যুক্তিসংগত পরিমাণ পিতা বা মাতা, অথবা উভয়কে নিয়মিত অর্থ প্রদান করবে অথবা তাদের মাসিক আয়ের দশ ভাগের এক ভাগ পিতা-মাতার ভরণপোষণের জন্য দেবে।

কোনো ব্যাক্তি যদি বাবা-মায়ের ভরণপোষণ আইন অমান্য করে, তবে অপরাধের আমলযোগ্যতা, বিচার ও জমিনসংক্রান্ত বিধানে বলা হয়েছে, এধরনের অপরাধ প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বিচারযোগ্য হবে। তবে কোনো আদালত এ আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের বাবা-মায়ের লিখিত অভিযোগ ছাড়া আমলে নেবে না। পরবর্তী সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার, কিংবা ক্ষেত্রমতে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মেয়র বা কাউন্সিলর কিংবা অন্য যে কোনো উপযুক্ত ব্যাক্তির কাছে প্রেরণ করতে পারেন। ঐ অভিযোগ আপস-নিষ্পত্তির জন্য, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান-মেম্বার, মেয়র, কাউন্সিল উভয় পক্ষকে শুনানির সুযোগ প্রয়োগ করবেন এবং তা নিষ্পত্তি করবেন। এইরূপ নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ উপযুক্ত আদালত কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত বলে গণ্য হবে।

তবে শুধুমাত্র আইন দিয়ে এই অমানবিক বিষয় রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন প্রতিটি সন্তানের বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ হওয়া। পাশাপাশি সন্তানদের তাদের বাবা-মায়ের প্রতি যত্নশীল ও দায়িত্ববান হওয়ার জন্য বিভিন্ন অনুপ্রেরণামূলক ভাতা কর্মসূচি শুরু করা যায়। আমাদের উচিত এসব বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাহায্য এগিয়ে আসা এবং তাদের মানসিক ও আর্থিকভাবে সুরক্ষা প্রদান করা।

৫১তম ব্যাচ, আইন বিভাগ, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

ইত্তেফাক/এমএএম