বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিশ্বায়নের সংস্কৃতির ছায়ায় কতটা ঐক্য সম্ভব?

আপডেট : ২২ মে ২০২৩, ০৫:৩৩

‘ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল’ কিংবা ‘পাগলা দিদির মৃত্যুর সঙ্গে একটি যুগের অবসান হইল’—এই যে একটি কালের সমাপ্তি বা যুগের অবসান, এতে কী বোঝা যায়? এটা কি উপন্যাসের মোচড়, নাকি যে সুতা ছিঁড়ে যায় তাকে আর নাটাইয়ে বাঁধা যায় না সেটা? দুটিই সত্যি।

প্রতি ৭ থেকে ১০ বছরে মানুষের জীবনদর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনাচিন্তা, সংস্কৃতি, পোশাক, সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, ফ্যাশন, ট্রেন্ড, পালাপার্বণ, খাদ্যাভ্যাস, অর্থাৎ যাপিত জীবনের সঙ্গে যা কিছু জড়িত এমনকি মাদকাসক্তির ধরন, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ কিংবা ভয়ের অনুভূতি—সবই বদলে যায়। এর সঙ্গে যদি আবার যুক্ত হয় মহামারি কিংবা যুদ্ধ, তাহলে বদলের প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়। একটি নির্দিষ্ট ধরনের সংগীতচর্চা, পোশাকের ধরন কিংবা জীবনচর্চা মিলিয়ে সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ওঠা পাংক সংস্কৃতি এক্ষেত্রে মনে পড়ে যাবে। ষাটের দশকে অ্যালেন গিন্সবার্গকে কেন্দ্র করে কোলকাতার একদল তরুণ কবি আসক্ত হয়েছিলেন হিপি কালচারে। এক কানে দুল পরার ফ্যাশন ধারা চালু হয়েছিল বোহেমিয়ান কালচারে। বালুচরি কাজের কাতান, কাঞ্জিভরম শাড়ি আর সোনার গয়নার আভিজাত্যে ভাটা পড়েছে। এসেছে ওয়েস্টার্ন আউটফিট। কানবালা হারিয়েছে বনেদিয়ানা, সেখানে জায়গা করে নিয়েছে ফাংকি কানের দুল। রবীন্দ্র ও নজরুলসংগীতের পপকরণ জ্যাজকরণ হয়েছে, শ্রোতাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। বিশ্বাস, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, জীবানাচারের ক্রমশ পরিবর্তন কি শেষ পর্যন্ত জাতিগত অভ্যাসও বদলে দেয়? করোনাকালে হাত ধোয়ার জন্য গণমাধ্যমে চালানো হতো বহুমাত্রিক প্রচারণা। তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, নাগরিকদের হাত ধোয়াসহ প্রাথমিক স্বাস্থ্যচর্চার বিষয়গুলো চলে আসবে সরকারি নজরদারির আওতায়। কোভিড-১৯-এর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ভাবা হয়েছিল মানুষ আর কখনো উদ্বেগহীনভাবে আনন্দে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না। কবে মাস্ক খুলে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারবে, সেই অনুমান করা ছিল দুঃসাধ্য। চলাচল ও সমাবেশে স্বাধীনতার ধারণা আগের মতো শর্তহীন থাকবে না বলে যতটা কঠিনভাবে ভাবা হয়েছিল, ঠিক অতটা হয়নি। আবার অনেক ধারণা অনুমানমতোই ঘটেছে। ভাবা হয়েছিল, করোনা বিশ্বায়নকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে, সেটা ফেলেছে। বিশ্বায়নের স্বার্থ যে বাণিজ্যিক, রাজনৈতিক যৌথতা নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে। আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো করোনা জাতীয়তাবাদের ভয়ংকর রূপ দেখেছে। সংক্রমণের সময় ইওরোপের রাষ্ট্রগুলো যেভাবে নিজ নিজ সীমানা নিয়ে ভাগ হয়ে গেল, তাতে স্পষ্ট হয়েছে প্রাতিটি দেশের স্বার্থ। প্রমাণিত হয়েছে, ‘রাজনৈতিক যৌথতা’ প্রসঙ্গটি ফাঁকা আওয়াজ। এমনকি খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নও সম্মিলিতভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। আশপাশের দেশ থেকে কোনো সাহায্য না পেয়ে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুচিস বলেছিলেন, ‘ইউরোপীয় ঐক্য’ একটা রূপকথা।

সবকিছুই কি দ্রুত বদলে যায়? বিশেষ করে তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় মহামারি কিংবা যুদ্ধ। স্প্যানিশ ফ্লুর পর ক্ষুধা মেটাতে নারীরা কাজে নেমেছিল ব্যাপকভাবে। এটাও একটা মানসিক বদল বৈকি। করোনাকালে খাদ্যের সাপ্লাই চেইন যেভাবে ভেঙে পড়েছিল, তাতে পুঁজির স্বার্থ দেখার নৈতিক কার্যকারিতাও পড়েছিল চ্যালেঞ্জের মুখে। মহামারি ঝড় থামার পর পুঁজি তার পুনরুত্থানের জন্য অটোমেশনের ওপর জোর দিয়েছে। মহামারির পর প্রযুক্তির স্বাক্ষরতা বেড়েছে।

ইন্টারনেটের সৌজন্যে পড়াশোনা, বিনোদন, টাকাপয়সার লেনদেন, ব্যাংকিং থেকে শুরু করে প্রাত্যহিক জীবনচর্চা এবং চর্যায় বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। শপিং মল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, রেলস্টেশন এমনকি ভিড়ের বাসেও ফ্রি ওয়াইফাই জোন না থাকলে তা নতুন প্রজন্মের গ্রাহক টানতে পারছে না। যানজট এড়াতে অনেক করপোরেট অফিস ভিডিও কলিং, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে নিচ্ছে। নেট ব্যাংকিংয়ের সৌজন্যে ঘরে বসে টাকাপয়সা লেনদেন, ফিক্সড ডিপোজিট খোলা কিংবা পাশবুক আপডেট করা যাচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট-ভিসা তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু করা যাচ্ছে অনলাইনে। গ্যাস-বিদ্যুতের বিল তো দেওয়া যাচ্ছেই। বেশির ভাগ সেবদানকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থাকায় আগে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, এখন সেখানে কাজ হচ্ছে একটি ক্লিকেই। যানবাহনের টিকিট থেকে শুরু করে মাসের বাজার করার সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এসেছে ই-লার্নিং। মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং কিছুটা হলেও যানবাহনের সংকট কমিয়েছে। শহরের উল্লেখযোগ্য সড়কগুলোতে এলইডি বাতি জ্বলছে। মোবাইল ফোনে অর্ডার দিলে ঘণ্টার মধ্যে মিলে যাচ্ছে কোনো ব্র্যান্ডের খাবার। বিশ্বের সব নামিদামি চেইন শপের আউটলেট রয়েছে ঢাকায়। এক বছর আগেও ভাবা যেত না ঢাকায় বসেই মিলে যেতে পারে বুমে মার্সার, রেমন্ড উইল, পিয়েরে লাইনারের মতো নামিদামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব তো করোনাকালের আগেই চলছিল। কিন্তু মহামারির কাল কি এর গতিপথ দ্রুততর করেনি? পরিবর্তন দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়ম কিন্তু মহামারি কিংবা যুদ্ধ সেই পরিবর্তনের দ্রুতগামিতাকে বাড়িয়ে দেয়। লক্ষ করুন, রূপকথার রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কীভাবে বদলে গেছে। ফিল্মি বুদ্ধিজীবীরা হ্যারি পটারের চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করে দেখেছেন হ্যারির জন্য এখন আর হাঁসজারু বা বকচ্ছপসম অর্ধেক ঈগল ও অর্ধেক ঘোড়ার হিপোগ্রিফ যথেষ্ট নয়, হ্যারি টিনএজে পৌঁছেছে, বদলে গেছে তার ফ্যাশন ট্রেন্ড, হ্যারি পটারে যোগ হয়েছে পপ কালচার, পপ আর্ট। আমাদের কিশোর জগত্ও শুধু ভুতপ্রেত পরিস্থান আর পুতুলখেলা নিয়ে বসে নেই। কীভাবে বদলে যায় জনসংস্কৃতি! গান বা ফিল্মের সিডির দোকান এখন নিশ্চিহ্ন। একসময় ভাবা হতো, অনলাইন জগতের বিস্ময়কর সংযোজন ফেসবুক। এখন বিস্ময়কর সংযোজন বলে কিছু নেই। কেননা, প্রতিদিনই ঘটছে নতুন নতুন সংযোজন। যা কিছু প্রতিদিন ঘটে, তাতে তো আর বিস্ময় থাকে না। প্রেমিকের খোলা চিঠির বদলে ইনবক্সের মেসেজ, তাকে মিস করলে তক্ষুনি হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল আর ব্রেকআপের সপ্তাহ না পেরোতেই ডেটিং অ্যাপে চোখ—এই হলো স্মার্ট প্রেমের রসায়ন। সিভির বদলে এসেছে ডিজিটাল প্রোফাইল।

বলা হয়, পতি সাত বছরে সিনেমা দর্শকের রুচি বদলায়। একসময় জেমসবন্ড সিনেমা দেখার জন্য দর্শক সুপার সাইক্লোনের মতো আছড়ে পড়ত সিনেমা হলগুলোতে। এরপর এলো লাভস্টোরি ঘরানা। তারপর লার্জার দ্যান লাইফ। এখন চলছে স্পাই থ্রিলার।  যা হোক, পুরো বিশ্বেই স্বাস্থ্যসচেতনতার যে ঢেউ তুলেছিল করোনা, তা থেকে যদি আমরা শিক্ষা নিতে পারি সেটাই তাত্ক্ষণিক সামাজিক লাভ। এত দিনকার বিশ্ব সমাজটি যে সংহতি, সহমর্মিতা, দূরদৃষ্টি ও সমবেদনায় পূর্ণ ছিল না, তা যদি আগের অভাবগুলো পূরণ করে পূর্ণতা পায়, সেটাও এক পরিবর্তন ও লাভ। করোনার সময় আমরা দেখেছি, ডলার-পাউন্ড পকেটে নিয়েও অনেকে পণ্য পায়নি। এখান থেকেও যদি আমরা বুঝতে পারি যে ডলার খাওয়া যায় না, বেঁচে থাকার জন্য আমাদের উৎপাদনের ওপরেই নির্ভর করতে হয়, আর সেই উৎপাদনের প্রধান উৎস প্রকৃতিকে আমাদের আরো অনেক বেশি যত্ন করতে হবে, তা হবে এক লাভজনক ইতিবাচক পরিবর্তন।

যেদিন বিশ্বের সবাই বলবে যে, সবাই ভালো থাকুক, শত্রু-মিত্র, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ত্যাগী-ভোগী, গুণী-নির্গুণ সবাইকেই ক্ষমা করে দিতে পেরেছি, কারো কাছে কিছুমাত্র পাওনা নেই, সেদিন আমরা সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারব। তার জন্য কোনো সাংস্কৃতিক আয়োজন আছে? সেই পরিবর্তনের ধারায় যেতে পারলেই হতো সবচেয়ে ভালো।  

লেখক : কথাসাহিত্যিক

 

ইত্তেফাক/ইআ