মঙ্গলবার, ০৬ জুন ২০২৩, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

আপডেট : ২৫ মে ২০২৩, ০৩:৪৪

গত কয়েক দশকে দেশে লক্ষণীয় অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া বা ভারতের মতো বাংলাদেশেও একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব অনুভূত হয়েছে। অবশেষে গভীর সমুদ্রবন্দরের দীর্ঘদিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্বাধীনতার ৫২ বছর পর ধীরে ধীরে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির ক্রমবর্ধমান পরিমাণ পরিচালনা করতে এবং দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের ওপর চাপ কমাতে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে বাংলাদেশ কক্সবাজারে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, মাতারবাড়ী শিগিগরই গুরুত্বের দিক থেকে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের অন্যান্য আমদানি-রপ্তানির হাবকে ছাড়িয়ে যাবে।

কোভিড মহামারি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের নির্মাণকাজ পুরোদমে চলছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের অংশ হিসেবে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, একটি এলএনজি টার্মিনাল ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা নির্মিত হবে। প্রথম পর্যায়ে ১ মিলিয়ন ২০  ফুট সমতুল্য ইউনিট (TEUs) পরিচালনক্ষমতাকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৬ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর আগেই ২৫ এপ্রিল মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গভীর সমুদ্রের জেটিতে ডক করেছিল ২২৮ মিটার দৈর্ঘ্যের পানামার জাহাজ ‘আউসু মারো’। এটি দেশের যে কোনো বন্দরে নোঙর করা সবচেয়ে বড় জাহাজ ছিল।

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নত করা, বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়তার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল ও ভুটানের পাশাপাশি আশপাশের অন্যান্য অঞ্চলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বিস্তৃত করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।

এই বন্দর একটি উল্লেখযোগ্য ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে কাজ করবে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে আঞ্চলিক অন্যান্য দেশের সংযোগ স্থাপন করবে, বাণিজ্য ও ব্যাবসায়িক কার্যক্রম বাড়িয়ে তুলবে। জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ২০২০ সালে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে একটি শিল্পকেন্দ্রের ধারণার প্রস্তাব করেছিলেন। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে একটি শিল্পকেন্দ্র গড়ে তুলতে সে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিশিদা সম্প্রতি ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে এবং লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের হতে সাহায্য করবে।

বঙ্গোপসাগরের উত্তরে বদ্বীপ অঞ্চলে কৃষি ও খনিজ সম্পদের একটি উর্বর ভূমি রয়েছে, যা এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল অঞ্চল বঙ্গোপসাগরে একটি শিল্প পাওয়ার হাউজে উদীয়মান এশিয়ার দেশগুলো বিনিয়োগ করে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্ভবনাকে উন্মোচন করা যাবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সড়ক ও রেলযোগাযোগ ভবিষ্যতে পূর্ব এশীয় অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলে একটি শিল্প প্রবৃদ্ধি বেল্ট তৈরি করতে পারে। বেসরকারি পুঁজি, বহুজাতিক করপোরেশন ও মোবাইল শিল্পকে এই এলাকায় প্রলুব্ধ করে অবকাঠামো বিনিয়োগের মাধ্যমে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ শক্তিশালী হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ইউরোপে কোনো পণ্য পাঠানো হয় না। কার্গো কনটেইনারগুলো প্রথমে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর বন্দরে নেওয়া হয়। পরে এটি একটি বড় জাহাজে করে (মাদার ভেসেল) ইউরোপে পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ফলে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ শেষ হলে রপ্তানিপণ্য সরাসরি মাতারবাড়ী থেকে ইউরোপ বা আমেরিকার যে কোনো বন্দরে যেতে পারবে। ফলে খরচ কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য শিপিং করতে ৪৫ দিন সময় লাগে। মাতারবাড়ী বন্দর চালু হলে সেখানে পণ্য যেতে সময় লাগবে মাত্র ২৩ দিন।

গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ী ও অন্যান্য বন্দরের মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি নয়। চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত সামুদ্রিক দূরত্ব ৩৪ নটিক্যাল মাইল; পায়রা বন্দর ও মোংলা বন্দর থেকে মাতারবাড়ীর দূরত্ব যথাক্রমে ১৯০ ও ২৪০ নটিক্যাল মাইল। ফলে মাতারবাড়ীতে মাদার ভেসেল (একটি বিশাল কনটেইনার জাহাজ) থেকে পণ্য খালাসের পর দ্রুত সড়ক ও সমুদ্রপথে অন্যান্য বন্দরে নিয়ে যাওয়া যাবে। মাতারবাড়ী বন্দর পুরোপুরি চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখবে। জাইকার মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় মাতারবাড়ী টার্মিনাল সমুদ্রপথে সরবরাহ করা প্রতিটি ২০ ফুট লম্বা কনটেইনারে ১৩১ ডলার ও একটি ৪০ ফুট কনটেইনারে প্রায় ১৯৭ ডলার সাশ্রয় করবে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রবন্দর দেশের অর্থনীতিকে ২-৩ শতাংশ বৃদ্ধি করবে।

চট্টগ্রাম উপকূলের এই গভীর সমুদ্রবন্দর শুধু বাংলাদেশ নয়, বঙ্গোপসাগর এলাকার সব দেশের অর্থনীতির জন্যই হতে পারে গেম চেঞ্জার। বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর সমগ্র অঞ্চল এবং এর পশ্চাত্ভূমি, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, উত্তর-পূর্ব ভারত, নেপাল ও ভুটান, সেই সঙ্গে ভারতের বাকি অংশও যৌথ ব্যবসা, শিল্প ও বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে উপকৃত হবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত কিছু সম্ভাব্য সুযোগ তৈরি করেছে :ক) গভীর সমুদ্রবন্দরটি আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনে হওয়ায় আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে শিল্প ব্যবসার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এন্ট্রি পয়েন্টে পরিণত হবে। এটি আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য এবং ব্যাবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করবে। খ) প্রকল্পকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে, যার ফলে প্রচুর কর্মসংস্থান ও আয় হবে। গ) বন্দরটি আন্তর্জাতিক অংশীদারদের বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ব্যবসার জন্য প্রবেশকে সহজ করে তুলবে। ঘ) বন্দর প্রকল্পের জন্য রাস্তা, রেল ও নদী নেটওয়ার্কসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা, আন্তঃআঞ্চলিক সংযোগ বাড়াবে এবং দ্রুত অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের দিকে মোড় নেবে।

এটি সত্য যে, আসিয়ান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক বাণিজ্য খুব বেশি একীকরণ হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্কেও কিছু কিছু বাধা রয়েছে, যা এ দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর বাণিজ্য একীকরণ থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হতে বাধা দিচ্ছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার অভাবে একে অপরের বাজারে সহজে ভৌত প্রবেশাধিকারের দ্বারা প্রদত্ত ভৌগলিক সুবিধা এবং বাণিজ্যের কম ট্রানজিট খরচ সম্পূর্ণরূপে লাভ করা যায়নি। মাতারবাড়ী কেন্দ্রিক বাণিজ্য ও অবকাঠামো বিনিয়োগের মাধ্যমে এটি পরিবর্তন হবে।

ভারত ও বাংলাদেশের এমন কিছু এলাকা রয়েছে, যেগুলো প্রাথমিকভাবে ভূমিবেষ্টিত, ব্যাপকভাবে কৃষিপ্রধান, দারিদ্র্যের গড় হার অন্য জায়গার চেয়ে বেশি। যদিও সরকারি-বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা এতে ভূমিকা পালন করে, তবে গবেষণায় এটিও উঠে এসেছে যে, পিছিয়ে থাকা অঞ্চলগুলোর দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো : দেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্র থেকে অঞ্চলটির ভৌগোলিক দূরত্ব ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি।

অবকাঠামোর অভাব বা খণ্ডিত অবকাঠামো, বাণিজ্য বিধিনিষেধ এবং সীমান্ত জুড়ে বাধার কারণে কিছু কিছু অঞ্চল প্রায়শই প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যেমন—উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্য তাদের সংযোগগত দূরত্ব, উচ্চ পরিবহন খরচ এবং সীমাবদ্ধ ট্রানজিট বিকল্পের কারণে ভারতের অর্থনৈতিক কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ। কারণ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রভাব আগামী বছরগুলোতে অর্থপূর্ণ উপায়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে পৌঁছাতে পারে। পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোতে ট্রানজিট প্রবেশাধিকারের মাধ্যমে শুধু উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত নয়, নেপাল, ভুটান ও বঙ্গোপসাগরের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে গতিশীল করতে পারে, যা স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে একটি গেম চেঞ্জারের ভূমিকা রাখবে।

লেখক : সিনিয়র গবেষক, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, কানাডা

 

ইত্তেফাক/ইআ