শুক্রবার, ০৯ জুন ২০২৩, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা, পরিত্রাণ আসিবে কবে?

আপডেট : ২৬ মে ২০২৩, ০৪:৩১

গোটা পৃথিবী আজ অস্থির ও অশান্ত। করোনা মহামারি হইতে মুক্তি না পাইতেই গত বছর হইতে যে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়, তাহার সর্বনাশা অভিঘাত আজও বিদ্যমান সর্বত্র। ইহাতে পৃথিবীব্যাপী দেখা দেয় নূতন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ ইহা হইতে পরিত্রাণের পথ খুঁজিয়া পাইতেছে না। ইহারই মধ্যে জাপানে অনুষ্ঠিত হইয়া গেল জি-৭ সম্মেলন। এই সম্মেলনের ঘোষণায় ইউক্রেনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়। ইহার পরই আমরা দেখিলাম চীনে ছুটিয়া গেলেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিহাইল মিশুস্তিন। এই দুই দেশ পশ্চিমের সমষ্টিগত চাপের পরিপ্রেক্ষিতে যে ঐক্য গড়িয়া তুলিয়াছে তাহা পর্বতকেও টলাইয়া দিতে পারে বলিয়া মন্তব্য করা হইয়াছে। একদিকে চীন ও রাশিয়ার এই বন্ধুত্ব, অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশে নিরাপত্তাগত যে উৎকণ্ঠা তৈরি হইয়াছে, তাহাতে বিশ্বরাজনীতিতে উত্তাপ ক্রমশ বাড়িতেছে।

এদিকে হোয়াইট হাউজ চত্বরে ট্রাক লইয়া হামলা ও রাশিয়ার সীমান্তে উগ্রপন্থীদের ঢুকিয়া পড়িয়া আক্রমণ চালাইবার ঘটনাও উদ্বেগজনক। এতদিন ইউক্রেন যুদ্ধ ইউক্রেনের ভূখণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন কি ইহা রাশিয়ার অভ্যন্তরেও ঢুকিয়া পড়িল, এই প্রশ্ন আজ অনেকের। ইহার পরিণাম ও পরিণতি বা কী হইতে পারে, তাহাও চিন্তার বিষয় বটে। একই সময় ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাতভর চলিল রুশ বাহিনীর ড্রোন হামলা। একদিকে ইরানের ‘খাইবার’ চতুর্থ প্রজন্মের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উদ্বোধন, অন্যদিকে নরওয়ের রাজধানী অসলোতে বিশ্বের সবচাইতে বড় যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড বিমানবাহী রণতরির অবতরণ ইত্যাদি ঘটনায়ও শঙ্কিত বিশ্ববাসী। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান, শান্তিতে নাই কেহই। কখন যে সামান্য স্ফুলিঙ্গ হইতে বিশ্বে বড় ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ বাধিয়া যাইবে না, তাহার কোনো নিশ্চয়তা নাই।

ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের রূপ ও বিভিন্ন সমীকরণ বদলাইয়া দিয়াছে। ইহাতে ইউক্রেন ও রাশিয়ার বহু সৈন্যের মৃত্যু হইয়াছে। কাহারো কাহারো মতে, এই সংখ্যা তিন লক্ষাধিক। ইহার পাশাপাশি হতাহত হইয়াছে হাজার হাজার বেসামরিক লোকজনও; কিন্তু যাহারা এই দু্ই দেশের বাসিন্দা নন, তাহারা কি শান্তিতে আছেন? বিশেষ করিয়া এই যুদ্ধের কারণে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ পড়িয়াছে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্যে। সীমিত আয় ও সুশাসনের অভাব রহিয়াছে যেই দেশগুলিতে, তাহারা সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত। ধনী দেশগুলির সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারশেন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা ওইসিডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। উৎপাদন ক্ষতি তো আছেই, তবে এখনকার সবচাইতে বড় সংকট মূল্যস্ফীতি, পণ্য সরবরাহ ও ডলারের ঘাটতি। ইহাতে উন্নয়নশীল বিশ্বের ১১৬টি দেশের পরিবারগুলির জ্বালানি খরচ বাড়িয়াছে ৬৩ হইতে ১১৩ শতাংশ! এই সকল দেশে বিশ্বের ৮৭ শতাংশ মানুষ বসবাস করেন। কেবল জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের ৭ কোটি ৮০ লক্ষ হইতে ১৬ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে নামিয়া গিয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকব্যবস্থা মূল্যস্ফীতি কমাইতে নীতি সুদহার বাড়াইয়াছে সাড়ে ৪ শতাংশের অধিক। ইহাতে ডলারের দর বাড়িয়া গিয়া স্বল্প আয়ের দেশগুলি পড়িয়াছে আরও বড় সংকটে। এই জন্য স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করিতে হইয়াছে।

তবে সুখের বিষয় হইল—পৃথিবীর অর্থনীতি একটু একটু করিয়া ঘুরিয়া দাঁড়াইতে শুরু করিয়াছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি হইয়া উঠিতেছে সহজতর। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত কাঁচামালের মূল্য না কমিলেও ধারাটি উন্নতির দিকে। যদিও দুঃখের বিষয় হইল, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনিতে গিয়া সুদের হার বাড়ানো-কমানোর কারণে জার্মানিসহ কোনো কোনো দেশে দেখা দিয়াছে মন্দা পরিস্থিতি। জাতীয় অর্থনীতিকে অধিক করিয়া নিয়ন্ত্রণ করিতে গিয়া হিতে বিপরীত হইয়াছে। তবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে যে বড় ধরনের মন্দার আশঙ্কা করা হইয়াছিল সেই শঙ্কা এখন কমিয়া গিয়াছে। শীতকালে ইউরোপে গ্যাসের উৎপাদন কমে নাই; কিন্তু যুদ্ধের অবসান না হওয়া পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা যায় না।  অতএব, বিশ্ববাসী যুদ্ধবিগ্রহ এবং সকল প্রকার অশান্তি ও অস্থিরতা হইতে মুক্তি পাক—ইহাই আমাদের কামনা।

ইত্তেফাক/এমএএম