দু’দশক সময় ধরে ক্ষমতায় থাকার পর এবং এক ডজনেরও বেশি নির্বাচনের পর, তুরস্কের কর্তৃত্ববাদী নেতা রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জানেন কীভাবে সবকিছু সামাল দিতে হয়। ইস্তাম্বুলে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের এক সম্মেলনে এরদোয়ানকে কাছে পেয়েও মানুষের যেন আশ মিটছিল না। খবর বিবিসি।
অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরের মতোই তিনি জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তার ইশারা মতো ট্যাক্সি ড্রাইভাররা উল্লাস করছিলেন, হাততালি দিচ্ছিলেন।
সম্মেলনের স্থানটি ছিল বসফরাসের উপকূলে ইস্তাম্বুলের একটি কনভেনশন সেন্টার, যেটি নির্মিত হয়েছিল এরদোয়ান ঐ শহরের মেয়র থাকাকালীন সময়ে।
তুর্কি প্রেসিডেন্ট যখন তার ভাষণ শেষ করেন, সমাবেশের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে: ‘এক জাতি, এক পতাকা, এক মাতৃভূমি, এক দেশ।’ ততক্ষণে অনেক বয়স্ক ড্রাইভার উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলছিলেন ওপরের দিকে, কিংবা হাত তুলে প্রেসিডেন্টকে স্যালুট করছিলেন।
মাথায় স্কার্ফ আর রক্ষণশীল পোশাক পরে আয়েশে ওজদোয়ান ঐ সমাবেশে গিয়েছিলেন তার ট্যাক্সি ড্রাইভার স্বামীর সঙ্গে।
তার নেতার ভাষণের প্রতিটি শব্দ যাতে তিনি শুনতে পান সে জন্য বেশ আগেই মিটিং এ হাজির হয়েছিলেন। সিটের পাশে ছিল একটি ক্র্যাচ। তার হাঁটতে কষ্ট হয়, কিন্তু তারপরও তিনি ঐ সমাবেশে না গিয়ে থাকতে পারেননি।
‘এরদোয়ান আমার কাছে সবকিছু,’ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলছিলেন তিনি। ‘আমরা আগে হাসপাতালে যেতে পারতাম না, কিন্তু এখন আমরা সহজেই সেবা পাই। আমাদের এখন পরিবহন ব্যবস্থা আছে। তিনি রাস্তাঘাট উন্নত করেছেন। মসজিদ নির্মাণ করেছেন। দ্রুত গতির ট্রেন আর পাতাল রেল দিয়ে তিনি দেশকে উন্নত করেছেন।’
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভাষণে জাতীয়তাবাদী বক্তব্য ছিল ঐ সমাবেশের অনেকের কাছেই বেশ আকর্ষণীয়। এদেরই একজন হলেন ৫৮ বছর বয়সী কাদির কাভলিওলু, যিনি গত ৪০ বছর ধরে মিনিবাস চালাচ্ছেন। ‘যেহেতু আমরা আমাদের মাতৃভূমি ও জাতিকে ভালবাসি, তাই আমরা দৃঢ়ভাবেই প্রেসিডেন্টের পেছনে রয়েছি।’
‘আলু-পেঁয়াজের দাম বাড়ুক কিংবা কমুক,’ তিনি বলছেন, ‘প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা তার সঙ্গে আছি। আমার প্রিয় রাষ্ট্রপতিই আমাদের আশা-ভরসা।’
এমাসের শুরুতে তুর্কি ভোটাররা যখন নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়েছিলেন, সে সময় তারা তাদের মানিব্যাগের অবস্থার কথা বিবেচনা করে ভোট দেননি। তুরস্কে খাবারের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। ৪৩% মুদ্রাস্ফীতির কারণে অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে অসহনীয় ।
এই অবস্থার পরও প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, যিনি তুরস্কের অর্থনীতি এবং বাকি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন, ৪৯.৫% ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন।
এই ঘটনায় বিশ্লেষকরা বেকুব বনে গেছেন, এবং গুরুত্বপূর্ণ এক শিক্ষা লাভ করেছেন : 'জনমত জরিপের ফলাফল থেকে সাবধান।'
বিভক্ত এক দেশ
এরদোয়ানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীদলীয় নেতা কামাল কুলুচদারোলু নির্বাচনে পেয়েছেন মোট ৪৪.৯% ভোট।
সুতরাং, বিভক্ত এই দেশে ভোটাররাও ছিলেন বিভক্ত, বিরোধী দু’পক্ষের মধ্যে ব্যবধান ছিল মাত্র ৪% ভোটের।
একজন উগ্র-জাতীয়তাবাদী প্রার্থী সিনান ওগান ঐ নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে ৫.২% ভোট পেয়েছিলেন, যে কারণে নির্বাচনটি এই রোববার (২৮শে মে) দ্বিতীয় রাউন্ডের ভোটে যেতে বাধ্য হয়। ওগান এরপর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের প্রতি তার সমর্থন জানান।
তাহলে প্রশ্ন হলো, তুরস্কের অর্থনীতিতে এক বড় সংকট থাকার পরও কেন বেশিরভাগ ভোটার এরদোয়ানকেই বেছে নিলেন?
গত ফেব্রুয়ারিতে দেশজুড়ে বিপর্যয়কর জোড়া ভূমিকম্প, যাতে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, সেই ভূমিকম্প মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রবল সমালোচনার পরও ভোটাররা কেন তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন না?
‘আমি মনে করি তিনি একজন চূড়ান্ত ‘টেফলন রাজনীতিবিদ’ ,’ বলছেন অধ্যাপক সোলি ওজেল, যিনি ইস্তাম্বুলের কাদির হ্যাস ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক।
"তার যে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা রয়েছে, এটা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। তার শরীর থেকে ক্ষমতার আভা বের হয়। এটা এমন এক জিনিস যা কুলুচদারোলুর নেই।"
কুলুচদারোলুর প্রতি সমর্থন রয়েছে ছয়-দলীয় বিরোধী জোটের। তুর্কি জনগণকে তিনি আশার বাণী শুনিয়েছেন, এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু প্রথম রাউন্ডের হতাশাজনক ফলাফল দেখে তিনি নিজে এখন ডান দিকে মোচড় দিয়েছেন। তিনি এখন অনেক বেশি কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী। এটা দেখে একজন তুর্কি সাংবাদিক মন্তব্য করেছে: "এটা হচ্ছে পতনের রাস্তায় দৌড়।"
‘আমি এখানে ঘোষণা করছি যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেই আমি সব শরণার্থীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠাবো,’ কুলুচদারোলু সম্প্রতি এক নির্বাচনী সমাবেশে বলেছেন।
এসব শরণার্থীর মধ্যে রয়েছেন ত্রিশ লাখেরও বেশি সিরিয়ান, যারা গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচার আশায় দেশ ত্যাগ করেছেন। তুরস্কে এধরনের বার্তা শুনতে জনগণ খুব ভালবাসে।
তুরস্কের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যিনিই হোন না কেন, এই নির্বাচনে আসলে বিজয়ী হয়েছে জাতীয়তাবাদ।
ভোটাররা এযাবতকালের সবচেয়ে জাতীয়তাবাদী ও রক্ষণশীল এক সংসদকে নির্বাচিত করেছে, যেখানে এরদোয়ানের ক্ষমতাসীন এ.কে. (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) পার্টি জোটের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
তুরস্কের কিছু তরুণ ভোটার মনে করছেন, ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেছে। রঙধনু রঙের এক পতাকার নীচে একটি লাল সোফায় বসে ২১-বছর বয়সী জেইনেপ এবং ২৩-বছর বয়সী মের্ট গরম গরম তুর্কি চা পরিবেশন করছিলেন এবং নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করছিলেন৷
দু’জনেই বোগাজিচি বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন। এটি একটি সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যার রয়েছে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস। জেইনেপ এবং মের্ট-এর পরিচয় হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এলজিবিটিকিউ ক্লাবে, যেটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১৫ থেকে ঐ ক্যাম্পাসে সমকামীদের শোভাযাত্রা করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুরস্কের সমকামী সম্প্রদায়কে টার্গেট করে বক্তব্য দিয়েছেন। ইজমির শহরে এক বিশাল সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘এই জাতি থেকে কোনো এলজিবিটি মানুষ বের হবে না।’
‘আমাদের পারিবারিক কাঠামোকে আমরা কলঙ্কিত করি না। মানুষের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ায়, আমাদের পরিবারগুলো এমনই।’ কাঁধ পর্যন্ত কালো চুল এবং কানে দুল পরা মের্টের মনে হচ্ছে, তুরস্কের এলজিবিটি সম্প্রদায় এখন ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
‘এরদোয়ান নিজে, প্রতিটি বক্তৃতায়, প্রতিটি অনুষ্ঠানে, আমাদের লক্ষ্যবস্তু হিসাবে তুলে ধরছেন," বলছিলেন তিনি, “দিনের পর দিন রাষ্ট্র আমাদের শত্রু বানাচ্ছে।’
নতুন এক তুর্কি শতাব্দী
‘সরকার যখন কিছু বলে তখন তা সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। আপনি দেখবেন আপনার নিকটতম ব্যক্তি, এমনকি আপনার পরিবারের মধ্যেও এটি প্রতিফলিত হবে। এমন যদি চলতে থাকে, তাহলে এরপর কী হবে? আমরা সবসময় সতর্ক, সবসময় উত্তেজিত, আর সবসময় ভয়ের মধ্যে আছি,’ বলছিলেন তিনি।
জেইনেপ এখনও আশা করছেন একটি নতুন যুগের। কিন্তু তিনি জানেন যে সেই নবযুগ হয়তো নাও আসতে পারে। ‘আমার বয়স এখন ২১ বছর। আর তারা এখানে [ক্ষমতায়] রয়েছে ২০ বছর ধরে।
‘আমি পরিবর্তন চাই এবং সেটা যদি আমি না দেখি তাহলে আমি দু:খ পাব, ভয় পাব। তারা আমাদের ওপর আরও আক্রমণ করবে। তারা আমাদের অধিকার আরও কেড়ে নেবে। তারা আরও অনেক কিছু নিষিদ্ধ করবে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এর পরও আমরা কিছু একটা করব, এরপরও আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো।’
রোববার তুর্কি ভোটাররা তাদের দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ভোট দিতে যাবেন, যেটি হবে তুরস্কের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্ক একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পার হয়েছে প্রায় ১০০ বছর।
রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আবার নির্বাচিত হলে একটি নতুন ‘তুর্কি শতকের’ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তার সমর্থকরা বলছেন, তিনি আরও উন্নয়ন, আরও শক্তিশালী এক তুরস্ক উপহার দেবেন।