শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সুস্থ পরিপাকতন্ত্রের জন্য চাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস

আপডেট : ৩০ মে ২০২৩, ০০:০৫

গতকাল ২৯ মে ছিল বিশ্ব পরিপাক স্বাস্থ্য দিবস। এই দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকে ওয়াকিফহাল নন। কিন্তু বিষয়টি প্রত্যেক নাগরিকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পরিপাকতন্ত্রই হলো অধিকাংশ রোগের উত্সমূল। ভালো পরিপাক স্বাস্থ্য সঠিকভাবে খাদ্য হজম ও পুষ্টি শোষণ করে শরীরকে  রাখে সুস্থ, রোগ প্রতিরোধী ও বলবান। স্বাস্থ্যকর হজমশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্বল, পেট ফোলাভাব, বদহজম ইত্যাদি দেখা দেওয়ার আশঙ্কা কম।

গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্ট (জিআই ট্র্যাক্ট), লিভার, পিত্তথলি এবং অগ্ন্যাশয় পাচনতন্ত্রের প্রধান অংশ। মুখ, খাদ্যনালি, পাকস্থলী, ছোট ও বড় অন্ত্র এবং মলদ্বার নিয়ে গঠিত হয় জি আই ট্র্যাক্ট। এই বছর বিশ্ব পরিপাক স্বাস্থ্য দিবসের বাংলা প্রতিপাদ্য ছিল—‘আপনার পাচক স্বাস্থ্য : একটি স্বাস্থ্যকর অন্ত্র শুরু থেকে।’ স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং   স্বাস্থ্যকর জীবন ধারার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় সর্বোত্তম কার্যকর পরিপাকতন্ত্র, উপকারী আন্ত্রিক জীবাণু সম্ভারের সমতা এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। জন্মের সময় এবং মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে অণুজীবের সংস্পর্শে আসে বাচ্চারা। অন্ত্রের জীবাণু সম্ভার কেমন হবে সেটাও কিন্তু নির্ধারণ করে মা-বাবার ডি এন এ। পরিবেশগত এক্সপোজার এবং খাদ্য অন্ত্রের  জীবাণু সম্ভারকে পরিবর্তন করতে পারে, যা স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। বেশির ভাগ জীবাণু সহায়ক, কিছু ক্ষতিকারক হতে পারে এবং অন্ত্রের  জীবাণুর ভারসাম্য ব্যাহত হলে রোগের ঝুঁকি বাড়ে। 

জন্ম থেকেই, খাদ্যনালি আমাদের দেহে পুষ্টি সরবরাহ করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, অন্ত্রের  জীবাণুর সমতা রাখে এবং মস্তিষ্ক-অন্ত্রের অক্ষের সঙ্গে একটি ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ হিসেবে কাজ করে। জিন, জীবনধারা, স্ট্রেস এবং খাদ্যদ্রব্য— এই চারটি বিষয় আমাদের সুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত। জেনেটিক সম্পর্কটাকে বিজ্ঞান এখনো পরিবর্তন করতে পারে না। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম নিয়ন্ত্রিত জীবনধারা, সুন্দর মনন, সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক কমিয়ে দেয়। একেবারেই আমাদের হাতের নাগালে যেটা আছে, সেটা হলো খাদ্য গ্রহণে সতর্কতা। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু অতিরিক্ত খাদ্য এবং বিশেষ কিছু খাবার আমাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং ক্যানসারের দিকে ঠেলে দেয়। 

বিজ্ঞানীরা চারটি খাবারকে আমাদের সময়ের প্রধান স্বাস্থ্য বিপদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। সেগুলো হলো— চিনি, ফ্যাট-ট্রান্স ফ্যাট, প্যাকেটজাত খাবার এবং লালমাংস। বিজ্ঞানমনস্ক ধারণার অভাবে অথবা প্রাচুর্যের কারণে মানুষ ক্রমেই স্থূল হচ্ছে। ধূমপান না করা, অ্যালকোহল কম বা না খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম করা, দৈনিক পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত ফলমূল শাকসবজি ও মাছ খাওয়া এবং প্রক্রিয়াজাত মাংস কম খাওয়া স্বাস্থ্যকর খাবারের নিয়ামক। তাজা খাবার, প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম, বীজ এবং মাছ স্বাস্থ্যকর খাবার। উচ্চ পরিশোধিত চিনি এবং শর্করা, ক্যালরিবিহীন চিনি, সম্পৃক্ত বা পরিবর্তিত চর্বি এবং প্রক্রিয়াজাত পরিশোধিত খাবার স্বাস্থ্যকর নয়। হালকা পাতলা শারীরিকভাবে শক্তিশালী, নিরোগ এবং মানসিক অস্থিরতাবিহীন জীবনই সবাই চায়। 

পৃথিবীর বহু দেশে যাওয়ার সুবাদে বিভিন্ন জাতির খাদ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। জাপানের মানুষ দীর্ঘজীবন উপভোগ করে। ওদের হার্টের রোগ ও কিছু ক্যানসার কম হয়। আমাদের মতো জাপানিদের প্রিয় খাবার ভাত। ওরা বলে, রান্নার পদ্ধতির ভিন্নতার কারণেই ওদের ভাত সুস্বাদু হয়। ওরা ভাতের সঙ্গে সমুদ্র আগাছা ও সাদা তিল মিশিয়ে খাদ্যমান বাড়িয়ে তুলে। বিভিন্ন ধরনের সবজি ফল, শস্য, মাঝারি পরিমাণে সয়া, মাছ, মিষ্টি আলু ওদের খাবার। ওদের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কম। অলিভ তেলে থাকে মনআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যা স্বাস্থ্যকর। সবার সেরা হলো রেপসিড ওয়েল যাতে থাকে ওমেগা ৩ এবং কম সম্পৃক্ত চর্বি। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে এবং সুইডেনে রেপসিড পাওয়া যায়। ভূমধ্যসাগরীয় দেশ ইতালি, গ্রিস, স্পেন খায় ন্যূনতম প্রক্রিয়াজাত তাজা ফল শাকসবজি এবং জলপাইয়ের তেল। শস্য, মাছ, মাংস ,বাদাম, বীজ ও শিম জাতীয় খাবারও তারা খায়। ওরা ছোট ছোট প্লেটে অল্প অল্প খাবার পরিবেশন করে এবং খুব ধীরে ধীরে খাবার খায়। ফ্রান্সের মানুষ হালকা পাতলা এবং স্বাস্থ্যবান যদিও ওরা মাখন, ফারমেন্টেড পনির এবং ক্রিম বেশি খায়। ফারমেন্টেড পনিরে প্রোবায়োটিক থাকে যা অন্ত্রে উপকারী জীবাণু বৃদ্ধি করে। ন্যূনতম প্রক্রিয়াজাত তাজা খাবার ওরা খায়। পশ্চিম আফ্রিকান খাবার স্বাস্থ্যকর। ওরা পর্যাপ্ত পরিমাণে আঁশযুক্ত খাবার খায়। তাজা সবজি ও ফল খায়। ভাত, গম, কাসাভা, আলু, বীজ, শিম জাতীম খাবার, তিল ও মাছ ওদের প্রিয় খাবার। ল্যাটিন আমেরিকার খাদ্যাভ্যাস ভালো। ওরা পর্যাপ্ত পরিমাণে তাজা শাকসবজি, ফলমূল, শিম জাতীয় খাবার, মসলা ও মরিচ খায়। মরিচে ক্যানসার প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে। এদিকে প্রচুর চর্বিযুক্ত খাবার, বেশি পরিমাণে শর্করা ও অতিরিক্ত লবণ মিশ্রিত মাংস, ডিম ও দুগ্ধজাত খাবার খায় আমেরিকানরা। এই খাবারগুলো তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং অনেকে ক্রমেই মোটা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকছে—মানে হলো আমেরিকানদের খাদ্যাভ্যাস ভালো নয়। 

এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলব। মাংস, মাছ, ডিমের গুণমান নির্ভর করে এই প্রাণীগুলোর খাদ্য এবং পরিবেশের ওপর। প্রাকৃতিক মুক্ত পরিবেশে বড় হওয়া অরগানিক খাবার খাওয়া গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়ার মাংসে কনজুগেটেড লিনডিয়াক অ্যাসিড এবং মেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে যা মানুষের হার্টের ও ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। কীটনাশক ছাড়া উৎপাদিত ফল শাকসবজি স্বাস্থ্যসম্মত। হলুদ স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। হলুদ শরীরের চর্বি কমায়, যে কোনো প্রদাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, খাবার হজমে সহায়তা করে, অস্তিসন্ধি মাংসপেশিকে সাহায্য করে। হলুদ চর্মরোগ কমায় ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধরে রাখে। 

লেখক : বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক, গ্যস্ট্রোএন্ট্রারোলজি বিভাগ, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা  

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন