কংগ্রেস বিধায়ক বাইরন বিশ্বাসের তৃণমূলে যোগদান ঘিরে তুঙ্গে বিতর্ক। তিন মাস আগে উপনির্বাচনে তৃণমূলকেই হারিয়েছিলেন তিনি। রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত সাহার মৃত্যুতে শূন্য হয়েছিল মুর্শিদাবাদে সাগরদিঘি কেন্দ্রটি। এখানকার উপনির্বাচনে তৃণমূল ও বিজেপিকে পিছনে ফেলে জয়ী হন বাইরন।
বাম ও কংগ্রেসের জোট প্রার্থী জেতেন ২৩ হাজার ভোটে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই বিধানসভা আসনে তৃণমূলের পরাজয় ছিল চমকে দেয়ার মতো। জোট প্রার্থীর জয়কে 'সাগরদিঘি মডেলের' তকমাও দেয়া হয়। কিন্তু তিন মাসের মধ্যে সেই মডেলের 'মুখ' নিজেই যোগ দিলেন শাসক দলে।
সোমবার (২৯ মে) তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে ঘাসফুল পতাকা তুলে নেন বাইরন বিশ্বাস। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একটি আসনও জিততে পারেনি। বাইরন 'হাতের' খাতা খুলেছিলেন।
কিন্তু অল্প দিনেই আবার শূন্যে নেমে গেল রাহুল গান্ধী দল। সাংবাদিক বৈঠকে অভিষেক জানিয়েছেন, 'বেশ কিছুদিন ধরেই বাইরন তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন। সেটা আগে সম্ভব হয়নি। বাইরন ঠিক করে রেখেছিলেন, ভোটে জিতে তৃণমূলে নাম লেখাবেন।'
অভিষেকের পাশে বসে বিধায়কের বক্তব্য, 'কংগ্রেসে থেকে কাজ করতে পারছিলাম না। এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে তৃণমূলে যোগ দিলাম। আমি তৃণমূলেই ছিলাম, আমার জয়ে কংগ্রেসের অবদান নেই।' বাইরনের দলবদল প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কাছে বড় ধাক্কা।
যদিও তিনি বলেন, 'যে খেলা তৃণমূল খেলছে, সেই খেলাতেই একদিন তারা ধ্বংস হবে। মানুষের রায়কে মেনে নেয়ার ক্ষমতা তৃণমূলের নেই।' সাগরদিঘির ভোটে বামেরা পূর্ণ শক্তিতে ময়দানে নেমেছিল।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, 'কেনাবেচাই তৃণমূলের রাজনীতি। তাই ভোটে হেরে বিধায়ককে কিনেছে তারা। এটা সাগরদিঘির জনাদেশের অপমান।' অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দল ভাঙানোর অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন।
তার মন্তব্য, 'দল ভাঙার ইচ্ছে থাকলে বাইরনকে মুর্শিদাবাদে নবজোয়ারের কর্মসূচিতে যোগদান করাতে পারতাম। আমরা সেটা করিনি। এখনই বোতাম টিপলে কংগ্রেসের চারজন সাংসদ তৃণমূলে চলে আসবেন। কিন্তু আমরা দল ভাঙানোর পক্ষে নই।'
গত বিধানসভা নির্বাচনের পর বিজেপির একাধিক বিধায়ক ইতোমধ্যেই ঘাসফুল শিবিরে নাম লিখিয়েছেন। বাইরন প্রসঙ্গে দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, 'একজন বিধায়ককে কিনে সংখ্যালঘুদের আস্থা তৃণমূল ফেরত পাবে না। মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুরে সংখ্যালঘুরা দলে দলে কংগ্রেসে ফিরছেন। নির্বাচনে তৃণমূল সেটা বুঝতে পারবে।'
২০২১ এর ভোটে বাম, কংগ্রেস ও আইএসএফ জোট করে লড়েছিল। তাদের শিবিরের একমাত্র বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী বলেন, 'শাসক দল ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে বিধায়কদের তাদের দিকে টেনে আনে। বাইরনের ক্ষেত্রে কী হয়েছে জানি না। তবে এতে তৃণমূল বিরোধী লড়াইয়ে ভাটা পড়বে না।'
যে দলের বিরুদ্ধে সাগরদিঘির মানুষ ভোট দিয়েছিলেন, সেই দলেই যোগ দিয়েছেন বিধায়ক। এ কারণে সাগরদিঘির কংগ্রেস ও বাম কর্মীরা শুধু নন, ভোটারদের একাংশ বিধায়কের আচরণে ক্ষুব্ধ। বাইরনের পদক্ষেপকে 'অনৈতিক' বলে মনে করেন প্রবীণ সাংবাদিক আশিস ঘোষ।
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'একটা দলের বিরুদ্ধে ভোটে জিতে তিন মাস পর সেই দলেই যোগ দেওয়া এলাকার মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলাই যায়। গত কয়েক বছর ধরে দলবদলের এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।'
সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। কংগ্রেস ও তৃণমূল উভয়েরই এই মঞ্চে শামিল হওয়ার কথা। ১২ জুন বিরোধী দলগুলোর বৈঠক রয়েছে বিহারের পাটনায়। এরই মধ্যে বাইরনের দলবদলে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড ক্ষোভ জানিয়েছে।
একে 'বিশ্বাসঘাতকতা'র তকমা দিয়েছেন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা জয়রাম রমেশ। গোয়া, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের প্রসঙ্গ টেনে তার টুইট, 'এতে বিজেপির লাভ হবে, বিরোধীরা দুর্বল হবে।' তা হলে পশ্চিমবঙ্গের দলবদল কি জাতীয় স্তরে কংগ্রেস ও তৃণমূলের দূরত্ব বাড়াবে?
পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, কেন্দ্রে বিজেপিকে সরানোই এখন সোনিয়া গান্ধীদের লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে ততটা গুরুত্ব পাবে না। তাই এ রাজ্যে তৃণমূল ও কংগ্রেসের আসন সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না।
সেক্ষেত্রে বাম-কংগ্রেস জোটের কী হবে, তা নিয়েও জল্পনা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'আগামী মাস ছয়েকে যদি রাহুল গান্ধীর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হয়, তা হলে এ রাজ্যে কংগ্রেস ও তৃণমূলের বোঝাপড়া হতে পারে। তখন তৃণমূল এখানে কয়েকটা আসন ছেড়ে দেবে কংগ্রেসকে। সেক্ষেত্রে প্রবল দর কষাকষি হবে।'