বাজার শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের প্রয়াস যখন চালু হয়েছে, তখন থেকেই ‘বিনিময়’ বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এই বাজারের সঙ্গে আমরা প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত হই। আগে বাজার বলতে নির্দিষ্ট কোনো জায়গা বা স্থানকে বোঝানো হতো। বিশেষ করে আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে, মফস্সলে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে হাটবাজার চালু ছিল। এখন ইন্টারনেট যুগে প্রবেশ করার পর থেকে বাজার সর্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে, বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রক্রিয়া সূচনার পর থেকে বাজারের এই ধারণাও বহুলাংশে বিস্তৃত হয়েছে। বাংলাদেশে ফেসবুক এখন বড় ধরনের মার্কেট প্লেসে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে শাস্ত্রীয় ভাষায় বাজার হলো একটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি, যার মাধ্যমে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ‘চাহিদা’ ও ‘জোগান’ পণ্য ও সেবা উৎপাদনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে থাকে। স্বয়ংক্রিয় বাজারের এই পদ্ধতি কোনো কর্তৃপক্ষ বা সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত নয় বরং বিনিময় ভিত্তিতে গঠিত। সাধারণত, দেশের অভ্যন্তরে বাজারে মোট চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি থাকলে পণ্যের দাম কমবে আর চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকলে দাম বাড়বে। বাজারে জোগান ও চাহিদা প্রায় সমান হলে দাম স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়ে থাকে। তখন দামের তেমন ওঠানামা হয় না। বাজার অর্থনীতির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও প্রতিযোগিতার ধারণা সম্পর্কিত।
বাজার অর্থনীতির সুবিধা হলো এখানে সম্পদের বণ্টনটা অসংখ্য অর্থনৈতিক কুশীলবদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৎপাদন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যারা প্রত্যেক নিজেদের মুনাফা স্বার্থ দ্বারা তাড়িত। সমবেত ব্যক্তি প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফলে অর্থনীতিতে সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তবে মুনাফাতাড়িত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়—মুনাফা লোভ দুর্নীতির প্রবণতাও সৃষ্টি করে। সে কারণেই পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থায় দুর্নীতির প্রসার বেশি হতে পারে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে গণতান্ত্রিক, সমাজতন্ত্রী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ বা সরকারিকরণ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও সম্পদের রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করে।
স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোতে বিনিয়োগের সিংহভাগ আসত সরকারি খাত থেকে, যা ছিল মোট বিনিয়োগের ৮৫ শতাংশ। ১৯৭৩-এর শিল্পনীতিতে সব রকম মাঝারি ও বৃহত শিল্প জাতীয়করণ করা হয়। তবে ১৯৭৪-এর শিল্পনীতিতে সরকারের ভূমিকা কমিয়ে ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৭৫-এর সংশোধিত শিল্পনীতিতে ব্যক্তি খাতের দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীকে সরকারি খাতের করপোরেশনে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়, যদিও সরকারের শেয়ার বেশি রাখা হতো। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালের শিল্পনীতিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োকারীকে সরকারি করপোরেশনে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালের নতুন শিল্পনীতি থেকে পুরোপুরি বিরাষ্ট্রীয়করণের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ব্যক্তি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। শিল্পনীতির সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যনীতির পরিবর্তন শুরু হয় ১৯৮৫ সালের পর থেকে। বাণিজ্যনীতির সংস্কারের মধ্যে ছিল কিছুটা বাজারভিত্তিক বিনিময় হার, মুদ্রা ও সেই সঙ্গে রাজস্ব নীতি সম্পর্কিত প্রণোদনা। রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে রপ্তানি বহুমুখীকরণ, উচ্চমূল্য সংযোজন রপ্তানি, রপ্তানি পণ্যের গুণমান উন্নয়ন ও পশ্চাত্পদ সংযোগ শিল্প স্থাপনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে আইএমএফের কাঠামোগত সমন্বয় সুবিধার আওতায় সরকার সাহায্যদাতাদের সন্তুষ্টি বিধানেই মূলত মধ্যমেয়াদি কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংক ও অন্য উন্নয়ন সহযোগীরা অধিক সহযোগিতার হাত বাড়ায়। আইএমএফ যে ৩৫টি দেশকে এ কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসে তার মধ্যে বাংলাদেশ ছিল প্রথম সারির গ্রহীতা। এ কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ। এ কর্মসূচির আওতায় যে খাতগুলোতে সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় সেগুলো হলো—কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সরকারি সম্পদ আহরণ, সরকারি ব্যয়, সরকারি সংস্থা বেসরকারিকরণ, আর্থিক খাত, বৈদেশিক খাত, পরিবেশ ও দারিদ্র্য বিমোচন।
উপরিউক্ত সংস্কার পদক্ষেপের মূলে ছিল বাজার শক্তিতে কাজে লাগিয়ে বাজার ব্যবস্থাকে সবার জন্য সহজ ও উন্মুক্ত করা, বাজারের মাধ্যমে পণ্যবণ্টন কার্যকর করা, প্রতিযোগিতাকে উত্সাহিত করা, শিল্পের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা, বাণিজ্যব্যবস্থাকে যথাসম্ভব উন্মুক্ত করে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং সর্বোপরি ব্যক্তি খাতকে অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে সরকারকে রেফারির বা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করা। বাজার অর্থনীতির অনুকূলে বস্ত্র ও পাটশিল্পের বেসরকারিকরণ সম্পন্ন হয়। এর ফলে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, রপ্তানিমুখী শিল্প, বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ফার্মাসিটিকেলস্?, কৃষিপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প এবং সংযোজন শিল্পের বিকাশ ঘটে। রেগুলেটরি প্রক্রিয়া সহজ হওয়ার ফলে মাঝারি ও বৃহত শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ অন্যতম বৃহত পোশাক রপ্তানিকারকে পরিণত হয়। রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ এই খাতে দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ধারাবাহিক সরকারগুলোর উদারীকরণ নীতির ফলে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল পেতে শুরু করে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বাজার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য অবকাঠামো বিশেষ করে সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করে। এর ফলে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সড়ক সুযোগসুবিধার কারণে গ্রোথ সেন্টারের (বাজারের) সঙ্গে সাধারণ মানুষ অধিক সংযুক্ত হয়। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ ও মুঠোফোন কোম্পানির সম্প্রসারণের ফলে যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। ব্যক্তি খাতে প্রিন্ট মিডিয়া-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে তথ্যপ্রবাহেও প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করা হয়, যা ছিল বাজারভিত্তিক অর্থনীতি বিকাশে অত্যন্ত সহায়ক।
শুধু বাণিজ্য বা শিল্প নয়, শিক্ষাক্ষেত্রেও নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাজার অর্থনীতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবির্ভাব হয়। বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত বিকাশের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যাগত আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের সম্প্রসারণ বাজার অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের ফসল। বর্তমান সরকার ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে আরও উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ দেয় এবং বিদ্যুৎ খাতে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
বাজার অর্থনীতির এই যুগেও মাঝেমধ্যে বাজারে শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটে, অর্থনৈতিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘বাজার ব্যর্থতা’। ‘বাজার ব্যর্থতা’ বলতে বাজার অর্থনীতির পণ্য ও সেবার অকার্যকর বণ্টনকে বোঝানো হয়। এর অনেক কারণ রয়েছে, তবে আমাদের দেশে এর মূল কারণ হলো দুটি—প্রথমটি হলো কখনো কখনো ব্যবসায়ী শ্রেণির কোনো কোনো অংশ কর্তৃক কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট কোন বিশেষ পর্যায়ে বাজারের প্রতিযোগিতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। বাজারে কোনো একটা প্রয়োজনীয় নির্দিষ্ট পণ্যের যদি সরবরাহ বা উৎপাদনের ক্ষমতা কতিপয় প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির হাতে সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে বাজার বাজার নিয়ন্ত্রিত হয় এবং মূল্যবৃদ্ধির প্রয়াস চলে।
আবার কোনো উপলক্ষ বা নির্দিষ্ট সময়ে চাহিদা হঠাৎ বেড়ে গেলে যদি আমদানি নিয়ন্ত্রিত হয়, সেক্ষেত্রে বাজারে সংকট সৃষ্টি হতে পারে, যদি সে অনুযায়ী সরবরাহ বা জোগান না থাকে। যেমন—আমাদের দেশে রমজানের সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। আর দ্বিতীয়ত হলো, বাজারব্যবস্থায় অবাধ তথ্যপ্রবাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাজারে পণ্যের উৎপাদন বা আমদানির সম্পূর্ণ তথ্য প্রচারিত না হলে কিংবা উৎপাদন তথ্যে ভুল থাকলে চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে দেখা যায়, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি হবে—ঘোষণায় পেঁয়াজের দাম দ্রুত কমে যায়। ডিম আমদানির সুযোগ দেবে বললে, ডিমের দাম কমে আসে। মানে অদৃশ্য সিন্ডিকেশন তখন পণ্য বণ্টনের নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে। সেজন্য বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সরকারি ভূমিকার গুরুত্ব আমাদের অনুধাবন করতে হবে এবং ভোক্তা ও উৎপাদক এই দুইয়ের স্বার্থের মধ্য ভারসাম্য রাখতে হবে। রপ্তানি যেমন, আমাদানিকেও উন্মুক্ত করতে হবে, তখন উৎপাদকের দোহাই দিয়ে ১৭ কোটি ভোক্তার পকেট কাটা যাবে না। বাজার সিন্ডিকেশনের প্রভাব ভাঙার পুরো ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকতেই হবে। সিন্ডিকেশন ভাঙার মহৌষধ আমদানি সুযোগ সুলভ ও উন্মুক্ত রাখা তবে আমদানিকারকের সংখ্যা সীমিত হলে তারাও সিন্ডিকেশন করতে পারে, সরকারকে এ বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় প্রতিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে নয়, উৎপাদন খরচ কমানোর সহায়তা করতে হবে, খরচ কমানোর উপায় বাতলে, তা না হলে আমদানি নিয়ন্ত্রণে ভোক্তাকে অধিক মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হবে। বাজার অর্থনীতির সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জনে বাজার অর্থনীতিকে কাজ করতে দিতে হবে।
লেখক: সামষ্টিক পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়