এমন মানুষ সম্পর্কে ইংরেজিতে প্রবচন আছে, Larger than life। জীবনের চেয়ে বড়। সংক্ষিপ্ত জীবনে তারা জীবন ও জগেক তাদের কর্মগুণে যেভাবে সমৃদ্ধ করেন, তাই তাদের করে চিরস্মরণীয় এবং বরণীয়। মানিক মিয়া এমনই একজন কৃতিধন্য মানুষ ছিলেন
১৯৬৯-র ৯ জুন ইত্তেফাক পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলার সবচাইতে জনপ্রিয় সাংবাদিক’ শিরোনামে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া (মানিক মিয়া) সম্পর্কে লিখেছিলেন, ব্যক্তিজীবনের নির্ভীকতা ও সততা তার রচনাগুলোকে প্রভাবিত করেছে, জীবনের ন্যায় লেখার মধ্যেও তিনি কোনোদিন মিথ্যার প্রশ্রয় দেননি। তার দৃষ্টি ছিল গণমুখী। জনগণের কথা বলার জন্যই তিনি লেখনী হাতে নিয়েছিলেন। জনগণের ভাষায় তিনি কথা বলতেন। মানিক ভাই ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সাদাসিধে। বিলাস ও বাহুল্যকে তিনি কোনোদিন কাছে ঘেঁষতে দেননি। সামান্য আসবাবে সজ্জিত ছিল ‘ইত্তেফাক’ অফিসে তার ব্যক্তিগত বসবার ঘরখানি।
মানিক মিয়া সম্পর্কে মোটা দাগে সব কথাই বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কলামে। এমন কথায় কোনো অতিরঞ্জন নেই; আছে দুই জনের আন্তঃসম্পর্কের গভীরতা উত্সারিত বাস্তবতা। মানিক মিয়া অরাজনৈতিক ব্যক্তি হলেও, বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলেন অগ্রজের মতো নমস্য একজন; মানিক মিয়ার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
মানিক মিয়ার প্রথমত ও প্রধান পরিচয় সাংবাদিক হিসেবে; কিন্তু এমন পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার রাজনীতিমনস্কতা। কারণ তিনি ভাবতেন চলমান রাজনীতি নিয়ে, আর লিখতেন তার ‘মোসাফির’ কলাম নামের ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ উপসম্পাদকীয়তে, যা বেশ জনপ্রিয় ছিল। তিনি লিখতেন জনগণের কথা, জনগণের বোধগম্য ভাষায়, এবং তা শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির পক্ষে। জানা আছে, আওয়ামী লীগের অনেক সিদ্ধান্তের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল তার কলাম উত্সারিত পরামর্শসমূহ।
মানিক মিয়াকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চিনতে-বুঝতে তার লেখাগুলো অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করতে হবে, অনুচিন্তনে তা বুঝতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে উদ্ধৃতিযোগ্য একটি মন্তব্য মার্কিন নাট্যকার বিল অ্যাডলারের। তার কথা ছিল, ‘Nothing describes a person better than his words’— একজন মানুষের কথা দিয়ে যতটুকু বোঝা যায়, তা আর কিছুতে নয়। কথা তো দুই ধরনের—মুখনিঃসৃত আর কলমনিঃসৃত; অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে কাউকে কাউকে শুধু তার বলা কথা থেকেই চিনতে হয়; কারণ তার লেখা হয় নেই, বা দুষ্প্রাপ্য। মানিক মিয়া বলেছেন, লিখেছেনও; তার লেখা বই আছে, ভাষণগুলোও গ্রন্থিত করে ছাপা হয়েছে।
অর্থাৎ মানিক মিয়াকে চেনা-বোঝার মতো উপকরণ সহজলভ্য। তার বাংলা ও ইংরেজি লেখা আছে। দুই ভাষায় তার পারঙ্গমতা স্বীকৃত। জীবনালেখ্য ও মানসলোক মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১-তে, বর্তমান পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া থানায়। তার প্রয়াণ ১৯৬৯-এ ইসলামাবাদ ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। মাত্র আটান্ন বছর আয়ু ছিল তার। আজকের পৃথিবীতে যারা স্মরণীয়-বরণীয়, তারা কেউই দীর্ঘজীবী হতে পারেননি; তারা জীবনের দৈর্ঘ্য থেকে বঞ্চিত হলেও, কর্মে বা খ্যাতিতে ছিলেন অপরিমেয় সমৃদ্ধ। এমন মানুষ সম্পর্কে ইংরেজিতে প্রবচন আছে, Larger than life। জীবনের চেয়ে বড়। সংক্ষিপ্ত জীবনে তারা জীবন ও জগেক তাদের কর্মগুণে যেভাবে সমৃদ্ধ করেন, তাই তাদের করে চিরস্মরণীয় এবং বরণীয়। মানিক মিয়া এমনই একজন কৃতিধন্য মানুষ ছিলেন।
তিনি আরো আয়ু পেলে আমরা হয়তো-বা সমৃদ্ধতর হতাম; কিন্তু সমৃদ্ধ তো কম হইনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি, যার সৃষ্টিতে তার অবদান স্বীকৃত সত্য। তিনি স্বাধীনতার পর বেঁচে থাকলে দেশটি তার বিবেক উত্সারিত সাহসী দিকনির্দেশনা পেত; স্বাধীন দেশে নবযাত্রা করা সাংবাদিকতা আলোর দিশা পেত। বিবেকী সাহসের উচ্চারণ এখন দুর্লভ। কাজেই মানিক মিয়ার অবর্তমানে দেশটি বেশ বঞ্চিত ও দরিদ্র।
মানিক মিয়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বরিশাল বি এম কলেজের স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু বক্তৃতা ও লেখায় যে মানিক মিয়া উদ্ভাসিত, তাতে মনে হয়, তিনি আপন মেধায় স্বশিক্ষায় অনেকদূর এগিয়েছিলেন। অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানিক মিয়ার জ্ঞান-অন্বেষার পাটাতন তৈরি করেছিল।
পেশাগত জীবন শুরু হয় পিরোজপুর মহকুমা কর্মকর্তার সহকারী হিসেবে; কর্মদক্ষতার গুণে সহজেই হয়ে যান বরিশাল শহরের জনসংযোগ কর্মকর্তা। অর্থাৎ তার জীবন শুরু হয় সরকারি চাকুরে হিসেবে; কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তার পেশাগত জীবনের পর্বান্তর হয় সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে। মানিক মিয়া ১৯৪৩-এ কলকাতা গিয়ে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ কার্যালয়ে সেক্রেটারি হিসেবে নতুন পেশাগত জীবন শুরু করেন। তবে সেখানেও বেশি দিন থাকেননি। সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি ইত্তেহাদ পত্রিকার পরিচালনা পর্ষদের সেক্রেটারি হলেন। উল্লেখ্য, পত্রিকাটি ছিল সোহরাওয়ার্দী প্রতিষ্ঠিত।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সোহরাওয়ার্দী মানুষ চিনতে ভুল করেননি। মানিক মিয়া আর বঙ্গবন্ধু দুই জনই ছিলেন তার স্নেহ ও সৌজন্যধন্য। মানিক মিয়া পরবর্তী জীবনে হয়েছিলেন সাংবাদিক কুলশিরোমণি, আর বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। মানিক মিয়া তার সাংবাদিকের মনন ও কলম দিয়ে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে বিবেকী সাহসের কথা উচ্চারণ করেছেন আর অনলবর্ষী সব লেখা লিখেছেন; অন্যদিকে সত্যলগ্ন সাহসী বঙ্গবন্ধু কালে কালে হয়েছেন রাজনীতির হিমাদ্রিসম ব্যক্তিত্ব—বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। সোহরাওয়ার্দী তার স্নেহধন্য এ দুই জনকে গণতন্ত্রের সবক দিয়েছিলেন। মানিক মিয়া কলম আর মুখ দিয়ে গুরুবিদ্যাচর্চা করেছেন আমৃত্যু; বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের চর্চা করেই বাংলাদেশ হাসিল করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দী যথার্থই একজন গুরু নেতা ছিলেন। নেতার অন্যতম বড় কাজ আগামীর নেতা তৈরি করা; সোহরাওয়ার্দী তা করেছিলেন। মানিক মিয়া হয়েছিলেন সাংবাদিকতার নেতা; আর বঙ্গবন্ধু রাজনীতির নেতা। উপরন্তু দুই জনই গুরুবিদ্যা অনুযায়ী আগামীর অনুসারী তৈরি করেছিলেন।
মানিক মিয়া ১৯৪৮-এ ঢাকা ফেরেন; এবং তারপরেই তার সাংবাদিকতার স্ফুরণ হতে শুরু করে। ১৯৫১-তে তিনি মওলানা ভাসানীর কাছ থেকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের দায়িত্ব বুঝে নেন। ১৯৫২-তে (২-১২ অক্টোবর) তিনি পিকিং (এখন বেইজিং) এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় শান্তি সম্মেলনে যান। বিশ্বপরিসরে মানিক মিয়ার এই প্রথম অভিজ্ঞতা। উল্লেখ্য, এই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুও গিয়েছিলেন। ১৯৫৩-তে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক হয়ে যায় দৈনিক ইত্তেফাক। তারপর থেকে দৈনিক পত্রিকাটি জনগণের কাছাকাছি চলে যায়। সম্পাদক একটি পত্রিকার চরিত্র ও প্রকৃতি নির্ধারণ করেন, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মানিক মিয়ার ভাগ্যে কিছু সরকারি তকমা জুটেছিল। তিনি ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন (১৯৬৩)। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সরকারি প্রেস কোর্ট অব অনার্সের সেক্রেটারি এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ)-এর পরিচালক। উল্লেখ্য, দুইটা প্রতিষ্ঠানই ছিল সরকার পোষিত।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) মানিক মিয়ার ভাগ্যের চাকা বিপরীত দিকে ঘুরতে শুরু করে। সোহরাওয়ার্দী-শিষ্য আর সামরিক স্বৈরাচার সমান্তরালবর্তী হওয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই বিবেকী মানিক মিয়ার জন্য সামরিক স্বৈরাচার ছিল অশনিসংকেত। তিনি তিন বার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।
১৯৫৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে তিনি এক বছরের জন্য কারারুদ্ধ হন। ১৯৬২-তেও তাকে কারাজীবন ভোগ করতে হয়। তবে ১৯৬৬-র ১৬ জুন তার কারাজীবন ছিল বেশ দুঃসহ। তার পত্রিকাও ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস সরকার বাজেয়াপ্ত করে; অন্য দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও সিনে-পত্রিকা সাপ্তাহিক পূর্বাণীও বন্ধ করে দেওয়া হয়। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর ইত্তেফাকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয় (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯); এবং পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হতে থাকে। মানিক মিয়া লোকান্তরিত হন ৩১ মে ১৯৬৯ (অথবা ১ জুন)। কাজেই তিনি কিছুদিন পুনরুজ্জীবিত ইত্তেফাকের কর্ণধার থাকতে পেরেছিলেন। মানিক মিয়া কোনোদিন রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ছিলেন না; তবে সমাজ ও রাজনীতির সংশ্লেষ আছে, এমন ইস্যুগুলোর প্রতি তিনি মানসিক ও চেতনাগত নৈকট্য অনুভব করতেন। ভাষা আন্দোলন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের জোরালো সমর্থনপুষ্ট ছিল। বলা হয়, ১৯৫৪-র প্রাদেশিক পরিষদের যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস বিজয়ের পেছনে প্রচার-প্রচারণায় মানিক মিয়ার ক্ষুরধার লেখনী অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
উপরন্তু, জনতার ঐক্যের স্বার্থে তিনি ১৯৫৫-৫৬-তে যুক্তফ্রন্টের কোয়ালিশনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। একই কারণে তিনি ১৯৫৬-তে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভায় কৃষক-শ্রমিক পার্টির অন্তর্ভুক্তিকে সমর্থন দান করেন। ১৯৬২-তে এনডিএফ তার সমর্থন পায়। ১৯৬৪-তে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ‘কপ’ (কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ)-এর পক্ষে কাজ করেন; পরের বছর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে তিনি আইয়ুবের বিরুদ্ধে সমর্থন করেন; এবং তা-ও সামরিক স্বৈরাচারের বিপরীতে গণতন্ত্র-ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
অবশ্য এর আগে ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ পুনর্জীবনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন মানিক মিয়া। কারণ তার ধারণা ছিল যে, এত রাজনৈতিক দলাদলিতে গণতন্ত্রের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। পরে অবশ্য এনডিএফের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তার মত পালটিয়েছিলেন। অর্থাৎ পুনরুজীবিত আওয়ামী লীগের পক্ষে মানিক মিয়া তার অবস্থান ধরে রাখলেন।
এরই মধ্যে মানিক মিয়া বাঙালির স্বার্থসংশ্লিষ্ট তিনটি কাজ করেছিলেন। এক, ১৯৬১-তে তার দূতিয়ালিতে তার বাড়িতে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির দুই জন কমরেডের সঙ্গে শেখ মুজিবের গোপন আলোচনা হয় একাধিক বার। কমরেড দুই জন ছিলেন মণি সিংহ ও খোকা রায়। নির্দলীয় হওয়ার কারণে মানিক মিয়া সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন; এ কারণে তার পক্ষে এমন দূতিয়ালি সম্ভব হয়েছিল। যাহোক, শেখ মুজিব তার বাঙালির স্বাধীনতা প্রকল্প সম্পর্কে বামদের অভিমত অবহিত হতে চেয়েছিলেন। তিনি আলোচনার শুরুতে বলেছিলেন, স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির মুক্তি নাই। কমরেড দুই জন তার সঙ্গে সহমত হলেও, সতর্ক করেছিলেন, স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্যে তখন না বলতে; কারণ, বাঙালিবিদ্বেষী আইয়ুব খান তখন ক্ষমতাসীন। শেষমেশ, সিদ্ধান্ত হয়, একটি যৌথ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম গড়ে তোলার। শেখ মুজিব অবশ্য বলেছিলেন, তিনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবেন না। (বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য মণি সিংহ, জীবন সংগ্রাম, ঢাকা : বর্তমান সময়, ২০০৩, পৃ. ২১৪-১৬।)
দুই, ১৯৬২-এর বড়দিনের মধ্যরাতের পর মানিক মিয়া তার অফিসে শেখ মুজিবের সঙ্গে ভারতীয় উপদূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জীর দেখা করিয়ে দেন। শশাঙ্ক তখন থাকতেন উয়ারীর চক্রবর্তী ভিলায়, যেখান থেকে ইত্তেফাক অফিস হাঁটাপথ দূরত্বে ছিল। শশাঙ্ক চক্রবর্তীর হাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে লেখা একটি চিঠি শেখ মুজিব হস্তান্তর করেন। চিঠিতে বাঙালির স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া হয়; এবং তা বাঙালির মান-মর্যাদা রক্ষা করেই। এই আলোচনাকে শশাঙ্ক ব্যানার্জী বলেছেন, ‘A momentous turning point in the history of South Asia.’ বর্তমান আলোচনায় আমরা মানিক মিয়া সম্পর্কে আগ্রহী; কাজেই শশাঙ্ক ব্যানার্জী মানিক মিয়া সম্পর্কে কী বলেছেন, তা জেনে নেওয়া যাক। উল্লেখ্য, এ আলোচনার আগে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর সঙ্গে মানিক মিয়ার চেনা-পরিচয় ছিল না, অবশ্য জানাশোনা ছিল। মানিক মিয়া সম্পর্কে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর কথা—Although personally I had never met Manik Mia before, his name was not unknown to me. I never missed reading his politically astute polemical columns in Bengali in The Daily Ittefaq extolling the virtues autonomy for East Pakistan. I could sense that he was shrewdly using the word autonomy as a camouflage, but, in reality he was building up case for liberation. অর্থাৎ মানিক মিয়ার কুশলী রাজনীতিকের রাজনীতি না করেও কলম-কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।
তিন, মানিক মিয়া না হলে ছয় দফার ইতিহাস বদলে যেত, বাঙালির স্বাধীনতাও অনিশ্চিত হতো। ১৯৬৬-র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আইয়ুববিরোধী সব দলের সভা হওয়ার কথা; আওয়ামী লীগও আমন্ত্রিত। শেখ মুজিব তখন বাঙালি-মুক্তির চিন্তা-কর্মে বিভোর। তাই তিনি ঠিক করলেন, লাহোরে শাহ আজিজুর রহমান যাবেন। এই কথা শুনে মানিক মিয়া শেখ মুজিবকে বললেন, ‘শাহ আজিজের ওপর আস্থা রাখা যায় না; সে কয়দিন আগে মুসলিম লীগ করত, আওয়ামী লীগে নতুন। তুমিই যাও; যা বলার তা একটু নোট করে নিয়ে।’ অগ্রজ মানিক মিয়ার কথা শেখ মুজিব রেখেছিলেন; তিনিই লাহোরে যান; কিন্তু ছয় দফা উপস্থাপন করতে পারেননি; করেছিলেন পরে, যা হয়েছিল বাঙালির বাঁচার দাবি, তাদের মুক্তিসনদ। সুতরাং বাংলাদেশ সৃষ্টিতে মানিক মিয়ার অবদান কম নয়। মানিক মিয়ার কথায় শেখ মুজিব লাহোর না গেলে বাঙালির ইতিহাস অন্যরকম হতো। (চলবে)
লেখক : চেয়ার অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)