মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

কৃষি যান্ত্রিকায়ন ইমার্জেন্সি

আপডেট : ০৭ জুন ২০২৩, ০২:৪৪

বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই কৃষি সম্ভাবনাময় একটি দেশ। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কৃষিতে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। ধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত পণ্য, সবজি, ফল চাষ, মুরগি, গবাদি পশু, দুধ উৎপাদন সব ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশ খাদ্য এবং আমিষের চাহিদা অভ্যন্তরীণভাবে অনেকটাই পূরণ করতে পারছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে চাষযোগ্য আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ফসল উৎপাদন আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। কৃষিতে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা এখনো কার্যত সেকেলে ধরনের চাষ পদ্ধতি নিয়েই পড়ে আছে। কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো না গেলে আমরা যতই কৃষিপণ্য উৎপাদন করি না কেন সেখানে লাভ কম হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ছাড়া কোনোভাবেই কৃষি খাতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি ব্যবহার করা যাবে না। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর অর্থ হচ্ছে তুলনামূলক কম খরচে বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা। উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে কৃষক কম খরচে এবং তুলনামূলক কম পরিশ্রমে অধিক ফসল ঘরে তুলতে পারবে। তারা উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য পাবে। একই সঙ্গে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকবে। সাধারণ ভোক্তা শ্রেণি তুলনামূলক কম খরচে কৃষিপণ্য ক্রয় করতে পারবে। তাই কৃষি খাতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিষয়টি এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কয়েকটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, গবেষণা ও অধিক ফলনশীল নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা এবং কৃষি যান্ত্রিকায়ন করা। সেকেলে ধরনের চাষ পদ্ধতির পরিবর্তে সর্বত্রই যান্ত্রিক চাষাবাদ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। শুধু যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষ করলেই চলবে না, ফসল তোলা থেকে শুরু করে মাড়াই ইত্যাদি সব কাজই যাতে যন্ত্রের সাহায্যে সম্পন্ন করা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিপণ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যান্ত্রিকায়ন করতে হবে। কৃষি যান্ত্রিকায়ন করা গেলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। একজন কৃষক আগের তুলনায় কম পরিশ্রমে অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারবেন।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের কৃষি যান্ত্রিকায়ন হয়েছে মূলত ধান উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্ষেত্রে যান্ত্রিকায়ন এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। জমি চাষ করা, ধান রোপণ করা, ধান কাটা, ধান মাড়াই ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও যান্ত্রিকায়ন হয়েছে। এখনো গ্রামের বেশির ভাগ কৃষক সনাতনি পদ্ধতিতেই জমি আবাদ ও ফসল উৎপাদন করে চলেছে। ধান চাষ ও মাড়াই বাদে অন্যান্য ক্ষেত্রে এখনো কৃষি যান্ত্রিকায়ন খুব একটা হয়নি। অথবা হলেও তা প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছেনি। হার্ভেস্টিংয়ের ক্ষেত্রে মাত্র ৮ শতাংশ এবং বীজ বপনের ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ যান্ত্রিকায়নের আওতায় এসেছে। অর্থাৎ কৃষি যান্ত্রিকায়ন হয়েছে খুব সামান্যই। আর একটি জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থায়। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের আবহাওয়া ক্রমশ তপ্ত হয়ে উঠছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে কৃষি খাতে কাজ করা এখন খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত কারণে নদীভাঙন দেখা দিচ্ছে। এতে উর্বর ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সৃষ্ট উদ্বাস্তুর সংখ্যা ব্যাপকহারে বাড়ছে। যারা একসময় কৃষিতে নিয়োজিত ছিলেন তারা অনেকেই উদ্বাস্তু হয়ে শহরে চলে আসছেন।

কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণকারী যে সব ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত হচ্ছে তাদের কৃষি খাতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে, কৃষিকাজে আকৃষ্ট করতে হলে সবার আগে ব্যাপক মাত্রায় কৃষি যান্ত্রিকায়ন করতে হবে। কৃষি যান্ত্রিকায়নের মাধ্যমে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে এসব উচ্চশিক্ষিত সন্তানরা তাদের পূর্বপুরুষদের পেশায় ফিরে আসতে উত্সাহী হবে। তারা যেহেতু আধুনিক প্রযুক্তিতে পারদর্শী তাই তারা খুব অল্প সময়ে কাজ করতে পারবে। যেহেতু সব কাজই যন্ত্রের মাধ্যমে করা হবে তাই তাদের পরিশ্রমও কম হবে। কৃষক পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তান যদি যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করে তাহলে তারা দুই ভাবে লাভবান হতে পারবে। তারা যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের জমি চাষ করবে। একই সঙ্গে অন্যের জমিতে চাষাবাদে সহায়তা করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবে। আমি নিশ্চিত যে, কৃষক পরিবারের একজন উচ্চশিক্ষিত সন্তান যখন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে পারবে তখন সে আর চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরবে না। তারা গ্রামেই আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে। গ্রামে সম্মানজনকভাবে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে উচ্চশিক্ষিতদের অধিকাংশই আর শহরে যেতে চাইবে না। আমরা যদি ব্যাপকভিত্তিক কৃষি যান্ত্রিকায়ন করতে পারি তাহলে কৃষিব্যবস্থায় বিপ্লব সাধিত হতে পারে। আমাদের কৃষিব্যবস্থায় যান্ত্রিকায়ন যেটুকু হয়েছে তা মূলত ধান আবাদের ক্ষেত্রে। গমে কিছুটা হয়েছে। এছাড়া ভুট্টায়ও কিছুটা যান্ত্রিকায়ন হয়েছে। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে এখনো যান্ত্রিকায়ন খুব একটা হয়নি। এ ব্যাপারে জোর দিতে হবে। কৃষিতে যাতে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ হতে পারে সে জন্য সরকার বিভিন্নভাবে সহায়তা করছে। এখন প্রয়োজন কৃষিযন্ত্রের ওপর বিপুল আকারে ভর্তুকি প্রদান করা। কৃষক যদি তুলনামূলক কম মূল্যে কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারে মূলত সে জন্যই কৃষিযন্ত্রের ওপর ভর্তুকি দিতে হবে।

আমাদের দেশের কৃষিব্যবস্থায় একটি সমস্যা হচ্ছে জমির খণ্ড-বিখণ্ডতা। কৃষক পরিবারের জমির পরিমাণ খুবই কম। পরিবারপ্রতি কৃষিজমির পরিমাণ গড়ে মাত্র দেড় বিঘা। অনেকেই মনে করেন, এই ছোট ছোট জমিতে চাষাবাদের জন্য যন্ত্র কীভাবে কাজে লাগানো যাবে? এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, কৃষকদের সবাই যন্ত্র কিনবে এমনটা নয়, তারা অর্থের বিনিময়ে যন্ত্রের সার্ভিস ক্রয় করবে। কৃষিযন্ত্রের সার্ভিস দেবে গ্রামের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিগত, যাদের কৃষিযন্ত্র কেনার সামর্থ্য আছে। কৃষি যান্ত্রিকায়ন সুবিধা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। কেউ যদি কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের সার্ভিস নিয়ে ধান কাটে তাহলে তার বিঘাপ্রতি খরচ হবে ১৪ হাজার টাকা। আর যদি কৃষিশ্রমিকের মাধ্যমে ম্যানুয়ালি ধান কাটা হয় তাহলে খরচ পড়বে ২৮ হাজার টাকা। আর যে ব্যক্তি নিজের ক্রয়কৃত যন্ত্র দিয়ে ধান কাটবে তার খরচ হবে ৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ যান্ত্রিক উপায়ে ধান কাটা হলে অর্থ, পরিশ্রম এবং সময় সবকিছুই সাশ্রয় হবে। যারা পরিশ্রমের কারণে কৃষিকাজে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চান না, তারাও যান্ত্রিক উপায়ে কৃষিকাজে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। কৃষি যান্ত্রিকায়নে প্রতিটি কৃষিপণ্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। কৃষি যান্ত্রিকায়ন করা গেলে অনেক দিক থেকেই তা লাভজনক। একদিকে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে। কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। আর বাজারে ভোক্তা সঠিক দামে একটি পণ্য পেতে পারবেন। গ্রামের যেসব ছেলে উচ্চ শিক্ষার্থে শহরে যায় তারা যদি গ্রামেই কাজ করার অনুকূল এবং উপযোগী পরিবেশ পায় তাহলে তারা সেই কাজ লুফে নেবে। এ জন্য তাদের কৃষিতে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। একজন উচ্চশিক্ষিত যুবক যদি কৃষিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার মতো পরিবেশ খুঁজে পায় তাহলে তার পক্ষে এখানে নিজেকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ উচ্চশিক্ষিত হলেই একজন মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা সৃষ্টি হয় না।

‘কৃষি উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে যুবক ছেলেদের যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে কৃষিতে উচ্চশিক্ষিত মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়বে। যে কোনো কাজে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশের কৃষক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই কৃষিকাজ করে। তাদের উৎপাদনশীলতা কম। তারা বেশি পরিশ্রম করলেও ফসলের মূল্য পান কম। কৃষি উদ্যোক্তা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষিত যুবকদের কৃষিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তাদের যদি তুলনামূলক স্বল্প সুদে ঋণদানের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে কৃষিতে বিপ্লব সাধিত হতে পারে। উল্লেখ্য, যে কোনো কাজ সঠিকভাবে করতে হলে শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা এদের ঋণদানের ক্ষেত্রে আগ্রহী হবে না। তাই তাদের জন্য বিকল্প পদ্ধতিতে ঋণদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কৃষি একটি অত্যন্ত জটিল ক্ষেত্র। প্রতিদিনই কৃষিতে নতুন নতুন টেকনোলজি আবিষ্কৃত হচ্ছে। সেই টেকনোলজি ব্যবহার করতে চাইলে অবশ্যই প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।

লেখক : প্রেসিডেন্ট, এসিআই এগ্রিবিজনেস ডিভিশন

অনুলিখন : এম এ খালেক

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন