শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ছয় দফা বাঙালির মুক্তিসনদ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রিম জন্মসনদ

আপডেট : ০৭ জুন ২০২৩, ১৪:৫০

ছয় দফা রাতারাতি কোন কর্মসূচী ছিল না। এর প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘদিনের  ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব, ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনের যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন-এসবই ছয় দফার ভিত তৈরি করেছে।

ছয় দফা গণমানুষের সামনে  আকস্মিকভাবে উত্থাপিত হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এর প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে।

একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দী, স্বাধিকারের দাবিতে যারা এক মোহনায় মিলেছিলেন। ছয় দফার জন্মের পেছনে মূল কারণ ছিল মূলত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য। জন্মের পর থেকে পাকিস্তান যেসব বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তার বেশীরভাগ ব্যায় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের ‘সোনালী আঁশ' পাট, বিদেশে রপ্তানি করে যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো সেটাও চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। বৈদেশিক বাণিজ্যের  প্রায় সমস্ত অর্থ ব্যায় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। 

পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের ১৯৭০ সালের রিপোর্টে দেখা যায় উন্নয়ন ও রাজস্ব খাতে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬০ শতাংশের বেশী ব্যায় করা হয়েছে। ১৯৫০ -৫৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের বাজেটের বণ্টনে পশ্চিম পাকিস্তানের মোট ব্যয় ছিল ৬৮.৩১ শতাংশ অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তানের মোট ব্যয় ছিল ৩১.৬৯ শতাংশ। ১৯৬৫- ৭০ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের মোট ব্যয় ছিল ৭১.১৬ শতাংশ এর অপরদিকে পূর্ব  পাকিস্তানে মোট ব্যয় ছিল ২৮.৮৪ শতাংশ। ফলে পশ্চিমাদের মাথাপিছু আয়ও বহুগুণ বেড়ে যায়। এভাবে ক্রমান্বয়ে বৈষম্যের ধারা অব্যাহত থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ আন্দোলন সংগ্রামে একতাবদ্ধ হতে থাকে।

আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির পর ষাটের দশকের শুরু থেকেই উন্নয়নের একটা প্রচারণা শুরু করে দিলেন। কিন্তু পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে পূর্ব বাংলার শোষণ ও বঞ্চনার করুন দৃশ্য তুলে ধরলেন । তার সাথে ছিল রাজনৈতিক বৈষম্য। প্রশাসনে ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিরা  ছিল বরাবরই  উপেক্ষিত ও অবহেলিত।  

১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক বৈষম্য মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, "১৭ দিনের পাক ভারত যুদ্ধের সময় ৬ দফার আশু পটভূমি তৈরি হয়েছিল। এই যুদ্ধের সময় লক্ষ্য করা গিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সামরিক দিক থেকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। সে কারণে এই অঞ্চলের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল”। অধ্যাপক হোসেন আরও বলেন, "শেখ মুজিব বলেছিলেন যে, এই যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নতুন গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে"।

যুদ্ধের সময় ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ না করায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে বলেছিলেন, “চীনের ভয়ে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে জড়াতে সাহস করেনি”। জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত লেফ্ট রাইট করে হেঁটে যেত তবুও তাদেরকে বাধা দেওয়ার মতো অস্ত্র বা লোকবল কিছুই পূর্ব বাংলার ছিল না। আর চীনই যদি আমাদের রক্ষাকর্তা হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাধলেই হয়”।

পাকিস্তান জন্মলগ্ন হইতে কেন্দ্রীয় সরকারের গণতন্ত্র বিরোধী, প্রভুত্বব্যঞ্জক ও বাঙালি বিদ্বেষী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ গুলির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানিদের মনের দিগন্তে পুঞ্জীভূত রোষ ধীরে ধীরে শাসক চক্রের অজান্তে ও অগোচরে প্রলয়ংকারী রুপ ধারণ করছিল। ইহারই অসংঘটিত ও স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৭ই জুন। 

১৯৬৫ সনে ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তাসখন্দে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদকে সাথে নিয়ে ওই দিন সম্মেলনে যান বঙ্গবন্ধু এবং আগের দিন সম্মেলনের বিষয় নির্ধারণী কমিটির সভায় ছয় দফা পেশ করেন ।  ছয় দফার তিনটি স্বতন্ত্র দিক ছিল । রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কাঠামো। ছয় দফাতে যে, রাজনৈতিক দাবি তুলে ধরা হয়েছিল সেটা অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এখানে অর্থনীতির বিষয়গুলো সবিস্তারে উল্লেখ ছিল। তখন আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অর্থনৈতিক বিষয়গুলো জোরোশোরে সামনে চলে এলো।

ছয় দফার দাবিগুলো ছিল এদেশের মানুষের প্রাণের দাবি। 

১। পাকিস্তান একটি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফেডারেশন হিসেবে গঠিত হবে।

২। ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র। অন্যান্য বিষয়গুলো থাকবে প্রদেশগুলোর হাতে।

 ৩। প্রতিটি প্রদেশের জন্য পৃথক তবে অবাধে হস্তান্তরযোগ্য মুদ্রা থাকবে। যদি একক মুদ্রা হয় তবে তাহলে মুদ্রা হস্তান্তর রোধ করার উপায় থাকতে হবে।

 ৪। রাজস্ব থাকবে প্রদেশের হাতে।

৫। প্রতিটি প্রদেশের মুদ্রা আয়ের জন্য পৃথক একাউন্ট থাকতে হবে।

৬। অঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিটি প্রদেশকে মিলিশিয়া রাখার অনুমতি দিতে হবে। 

ছয় দফার ঘোষনার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ এর পূর্ব পাকিস্তান প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি এই যে ৬ দফা দিলেন তার মূল কথাটা কী?” আঞ্চলিক ভাষায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন শেখ মুজিব  "আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই একটু ঘুরাইয়া কইলাম" । ঘুরিয়ে বলা এই এক দফা হলো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ স্বাধীনতা। 

এর আগে বিভিন্ন সময়ে এই অঞ্চলে স্বাধিকার আন্দোলনের দাবী উঠেছে কিন্তু ছয় দফার দাবীর মধ্যে দিয়ে এটি একক এজেন্ডায় পরিণত হয়। ছয় দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন, “আমার দফা আসলে তিনটা । কতো নেছো, কতো দেবা, কবে যাবা?” মজার বিষয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল এই কর্মসূচিকে 'বিচ্ছিন্নতাবাদী নকশা' হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার তীব্র সমালোচনা ও বিরোধিতা করে ছয় দফাকে 'dangerous agenda' বলে ঘোষণা দেয়। যেমন তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া করে মন্তব্য করেন যে, ছয় দফা ফর্মুলা একটি ‘successionist move' যা তিনি প্রয়োজনে অস্ত্রের ভাষায় উত্তর দিবেন বলে শাসান। 

১৯৬৬ সনের মার্চে, ঢাকায় নিজ রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ (কনভেনশন) এর এক সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “ if necessary the government of Pakistan would use the 'Language of Weapon' against those elements who would talk of the six point programme" (Moudud Ahmed, Bangladesh: Constitutional Quest for Autonomy 1950-1971; Page No. 87) 

আইয়ুব খানের মত জেনারেল মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানও মনে করেন, "Six Point Programme is nothing, but an unjust plan to divide the country" (Hasan Zaheer, The Seperation of East Pakistan: The Rise and Realization of Bengali Muslim Nationalism, 1994, Page 127 ) তখন জুলফিকার আলী ভূট্টোর পিউপলস্ পার্টি অব পাকিস্তান (পিপিপি) পশ্চিম পকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল। ভূট্টো আগাগোড়াই ভাবতেন ৬ দফা ভারতের কারসাজি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার লেখা গ্রন্থে তিনি বলেন, “ The well and long planned  conspiracy  with India  that came to light after 25th March" (Zulfikar Ali Bhutto, The Great Tragedy, 1971, Page 57 ) কিন্তু এ বিষয়ে কেউ কখনো বিষদ ব্যাখ্যা দেয়নি। 

প্রকৃতপক্ষে, ৬ দফার বিরোধিতা করার মত পশ্চিম পাকিস্তানিদের  না ছিল রাজনৈতিক না ছিল অর্থনৈতিক ভিত্তি। পাকিস্তানের ভৌগলিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছয় দফার ভিত্তিতে আত্মপ্রকাশ করে 'দ্বি অর্থনীতি থিসিস'। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের ন্যায্য পাওনা আদায়ের একমাত্র উপায় কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সীমিত করা। 

সুতরাং প্রথমত, ছয় দফা কর্মসূচি অকাট্য যুক্তিতে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একচেটিয়া আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে। দ্বিতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভবিষ্যতে যাতে ব্যবহৃত হতে না পারে তার পদ্ধতিগত বাঁধা নিশ্চিত করে। তৃতীয়ত, বৈদেশিক সাহায্য যাতে একচেটিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদ হতে না পারে তার ব্যবস্থা প্রণয়ন করে। চতুর্থত, ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তান যেন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত শিল্পজাত দ্রব্যের ক্যাপ্টিভ বাজারে পরিণত না হয় তা নিশ্চিত করে। এক কথায়, প্রথমত, ছয় দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে এক দেশ, এক অর্থনীতি-ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে 'দুই অর্থনীতি ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে রুপান্তরিত করা; এবং দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার বাঙালির জন্য চূড়ান্ত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা। 

এদেশের সাধারণ মানুষের মাঝে ছয় দফার প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষ্য করার মতো বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ এর ২৫ ফ্রেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনসভায় ছয় দফাকে 'নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ' হিসেবে উল্লেখ করেন। মাত্র ৩৫ দিনে প্রায় সমগ্র পূর্ব বাংলা ব্যাপী ৩২ টি জনসভায় বক্তৃতা করে বাংলার সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ছয় দফাকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেন। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ১৯৬৬সালের ৮ মে নারায়নগঞ্জ পাট কল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষন দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করেন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। এ ঘটনায় জনগনের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 

৭ জুন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর ও অন্যান্য নেতার মুক্তির দাবিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন তথা বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবীতে পূর্ণ দিবস হরতাল আহবান করেছিল। অভূতপূর্ব সে হরতালে সাড়া দেয় ছাত্র-শ্রমিক- জনতাসহ সারা দেশের মানুষ। হরতাল বানচাল করতে পুলিশ ঢাকা ও নারায়নঞ্জে মুক্তিগামী মানুষের মিছিলে গুলি চালায়। এতে ঢাকার তেজগাঁও এর শ্রমিক মনু মিয়া, ওয়াজিউল্লাহ সহ ১১ জন এবং নারায়নগঞ্জে শফিক ও শামসুল হক নিহত হন। আহত হন অনেকেই। ছয় দফা আন্দোলন প্রচারে নিয়োজিত দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেনকে ১৫ ই জুন গ্রেফতার করা হয়। ১৬ই জুন দৈনিক ইত্তেফাকের মুদ্রনযন্ত্র 'দি নিউ নেশন'। প্রিন্টিং প্রেসকে বাজেয়াপ্ত এবং দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সরকারের বিরুপ প্রচারণা ও অত্যাচারে ৬ দফা আর ও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৬ দফা যখন জনগনের ব্যাপক সমর্থন পায় ঠিক সেই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামি করা হয়। এই ঘটনায় মুজিব পরিণত হয় বাংলার মহানায়কে। সকারের ষড়যন্ত্র ছাত্র-যুব-জনতা ব্যর্থ করে দেয় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে । প্রিয় নেতাকে তারা সেনানিবাসের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন। 

শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচীর প্রশ্নে ছিল আপসহীন। তার কাছে এটি দফার রাজনীতি, নিছক দলীয় ম্যানিফেস্টো বা ভোট লাভের কৌশল পত্র ছিল না। ছয় দফা প্রচারকালে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণ থেকে তা সুষ্পষ্ট। যেমন এ দাবী সস্তা রাজনীতির স্লোগান নং ‘ইহা দলের প্রয়োজনে প্রণীত রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়', 'ছয় দফা কোন দল বিশেষের কর্মসূচী কিংবা ভোট লাভের কৌশল নয়। ইহা রুঢ় বাস্তবতার প্রতিধ্বনি এবং আমাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন, ' ছয় দফা বিনিময়যোগ্য বস্তু নয়', ‘ছয় দফা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন', 'ছয় দফা রাজনৈতিক দর-কষাকষির কোন ব্যাপার নহে', 'পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ছয় দফা','আমাদের অস্তিত্ব বজায় থাকিবে না। আমরা নিশ্চিহ্ন  হইয়া যাইব, ছয় দফার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা হইতে তাহা বুঝা যাইবে,' 'অতীতে জেল খাটিয়াছি, মামলার আসামী হইয়াছি। এবারও জেল খাটিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য পাওনা বা দাবীর ব্যাপারে কোনরূপ আপোষ করিতে প্রস্তুত নই',  'প্রয়োজন হইলে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে'। 

বঙ্গবন্ধুর এসব বক্তব্য বা উক্তি দ্বারা বোঝা যায় ছয় দফা প্রশ্নে তিনি কতটা অনড় বা আপসহীন ছিলেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে ছয় দফার ভিত্তিতে বাঙালিদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় কিছুতেই তাঁর লক্ষ্য ছিল না, সম্ভবও ছিল না। তাঁর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে বাঙালির জাতীয় শক্তি বা স্বাধীনতা অর্জন। ছয় দফার মর্মকথা ছিল তা-ই, যদিও একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অভ্যন্তরে থেকে সরাসরি স্বাধীনতার কথা বলা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। রাজনীতি বিজ্ঞানের এ পাঠ বঙ্গবন্ধুর ভালো করেই রপ্ত ছিল। তাছাড়া এ সম্পর্কিত উদাহরণও (নাইজেরিয়া ব্রায়াফা) তাঁর সম্মুখে ছিল। তাই একজন নিপুণ কৌশলীর মতো তিনি উপযুক্ত সময়টির জন্য অপেক্ষা করেছেন। এর মধ্যে নানাভাবে ও ভাষায় তিনি ছয় দফার পেছনে কী তাঁর আসল রাজনৈতিক লক্ষ্য , তা বাঙালিদের নিকট তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, "যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে" উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, 'এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলবো। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ'। 

পক্ষান্তরে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবিরা 'ছয় দফা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন।

বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হেগেল বলেছেন, বিশ্ব ইতিহাস মানুষের স্বাধীনতার চৈতন্যের অগ্রগতির ইতিহাস ('The history of the world is more other than the progress of the consciousness of freedom' - Hegel, The philosophy of History).

৬ দফা কর্মসূচী সমগ্র বাঙালির স্বাধীনতার চৈতন্যের চেতনামূলে বিস্ফোরণ  ঘটায়। তবে প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি বটে, তবে ৬ দফা বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে। এর ভেতরে বাঙালির জাতীয় মুক্তির বীজ নিহিত ছিল। একথায়, ৬ দফা ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ। বঙ্গবন্ধুর জীবনীকার বিশিষ্ট সাংবাদিক ওবায়দুল হকের ভাষায়, ৬-দফা হলো স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রিম জন্মসনদ (Birth Certificate Written in Advance) 

ঐতিহাসিক ৭ জুন বাঙালির স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক, অবিস্মরণীয় একটি দিন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে যেসব আন্দোলন বাঙালির মনে স্বাধীনতার চেতনা ও স্পৃহাকে ক্রমাগত জাগ্রত করেছিল ৬ দফা আন্দোলন তাঁরই ধারাবাহিকতার ফসল। এরই ধারাবাহিকতায় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির অবিস্মরণীয় বিজয়, একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চের গণহত্যা এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পথ পরিক্রমায় দেশ স্বাধীনতার অভীষ্ঠ লক্ষ্যে এগিয়ে যায়। লাল রক্ত আর রূপালী অশ্রুর বিনিময়ে অর্জিত হয় প্রসাধিত স্বাধীনতা।

লেখকঃ ড. আবদুল ওয়াদুদ, ফিকামলি তত্ত্বের জনক,  রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রেসিডিয়াম সদস্য -বঙ্গবন্ধু পরিষদ, প্রধান পৃষ্ঠপোষক- বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতি।

ইত্তেফাক/এএইচপি