শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রিয়াদে ইরান দূতাবাস, কতটা পোক্ত নতুন এই সৌদি-ইরান সখ্যতা

আপডেট : ০৮ জুন ২০২৩, ১০:০৭

সৌদি এক শিয়া ধর্মীয় নেতার ফাঁসির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শত শত লোক ২০১৬ সালের দোসরা জানুয়ারি তেহরানে সৌদি দূতাবাস ভবনে চড়াও হয়ে ভাংচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই ঘটনায় দুই দেশের ভঙ্গুর সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছিল। খবর বিবিসি।

সাত বছর পর রিয়াদে মঙ্গলবার খুলেছে ইরানের দূতাবাস। ধারণা করা হচ্ছে খুব দ্রুত তেহরানে খুলছে সৌদি দূতাবাস।

যে দুই দেশের শত্রুতা আর রেষারেষি গত চার দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যকে বিপর্যস্ত করেছে সেই ইরান আর সৌদি আরব মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় এক চুক্তি করার পর থেকে যেভাবে দ্রুত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে বিস্মিত হওয়ার মতো ।

তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে যাত্রী বিমান চলাচল শুরু হচ্ছে। একজন ইরানি সৌদি আরবে ৮ লাখ ডলারের কোরআন তেলাওয়াতের এক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। ইরান থেকে সৌদি আরবে ইস্পাত রপ্তানি শুরু হয়েছে। সুদানে আটকে পড়া ৬০ জন ইরানি নাগরিককে সৌদি নৌবাহিনী উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পর ইরান ও সৌদি কর্মকর্তাদের কোলাকুলি করতে দেখা গেছে এবং ইরানের সরকারি সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে খুব শিগগিরই প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রিয়াদ সফরের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই সফর হলে তা হবে ২০০৭ সালের পর কোনো ইরানি নেতার সৌদি সফর।

এসব উদ্যোগের পেছনে কপটতা দেখেছেন না বিশ্লেষকরা, তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন সৌদি আরব আর ইরানের এই সখ্যতার ভিত্তি কতটা শক্ত? কতদিন তা টিকবে?

এই সন্দেহের মূলে রয়েছে এই দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েনের দীর্ঘ ইতিহাস যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে কম-বেশি বিপর্যস্ত করেছে। যে টানাপড়েনের মূলে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে নেতৃত্ব নিয়ে শিয়া ইরান এবং সুন্নি সৌদি আরবের অব্যাহত প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

সৌদি এক শিয়া ধর্মীয় নেতার ফাঁসির প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শত শত লোক ২০১৬ সালের দোসরা জানুয়ারি তেহরানে সৌদি দূতাবাস ভবনে চড়াও হয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

কেন সৌদিদের ইরান ভীতি

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে আরব বিশ্বে ইরানের বিরুদ্ধে সন্দেহ বহুগুণে বেড়ে যায়।

বিশেষ করে সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো ভয় পেয়ে যায় আয়াতোল্লাহ খোমেনি হয়তো এখন তার ধর্মীয় বিপ্লবের রেসিপি আশপাশে রপ্তানি শুরু করে দেবেন। ফলে, তখন থেকেই ইরান এবং প্রতিবেশী সুন্নি আরব দেশগুলোর মধ্যে বৈরিতা আর রেষারেষি নতুন মাত্রা পেতে শুরু করে।

মার্কিন গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের সারাহ জাইমি সম্প্রতি তার এক গবেষণা নিবন্ধে লিখেছেন ১৯৮০র দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ থেকে শুরু করে একে এক লেবানন, ইয়েমেন এবং সবশেষে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের মূলে রয়েছে সেই রেষারেষি।

ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত শিয়া হুতি মিলিশিয়াদের বিদ্রোহ দমনে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরব। লেবাননে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া হেজবোল্লার প্রভাব খর্ব করতে সেদেশের সুন্নি গোষ্ঠীগুলোকে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে শুরু করে সৌদিরা। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাশার আল আসাদ সরকারের সমর্থনে ইরান অস্ত্র আর যোদ্ধা পাঠাতে শুরু  করলে সৌদিরাও আসাদ বিরোধীদের সাহায্য-সহযোগিতায় নেমে পড়ে।

লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সাদি হামদি বিশ্বাস করেন ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে এই বৈরিতা এবং সন্দেহ এতই গভীর যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে একটি বোঝাপড়ায় তা দূর হবেনা।

‘এটি সাময়িক একটি সন্ধি, সমাধানের কোনো সূচনা নয়। বড় কোনও অগ্রগতি নয়। সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা আগেও একাধিকবার হয়েছে। প্রেসিডেন্ট খাতামি সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট আহমেদিনেজাদ গিয়েছিলেন। তখন সম্পর্ক নিয়ে ভালো ভালো কথা হয়েছে, কিন্তু কিছুদিন পর আবার যা তাই,’ বিবিসিকে বলেন হামদি।

কিন্তু কেন এখন এই সন্ধি করতে উদ্যোগী হলো দুই দেশ? হামদি মনে করেন বিশেষ করে সৌদি আরব চাপে পড়ে কিছুটা বাধ্য হয়েই এই পথে গেছে।

নয় বছর ধরে যুদ্ধের পরও সৌদি আরব ইয়েমেনে তাদের সমর্থিত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে ব্যর্থ হয়েছে। হুতিদের বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের মাটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হচ্ছে। সিরিয়াতে বাশার আল আসাদের সরকার উৎখাতের চেষ্টায় কাজ হয়নি।

বেইজিংয়ে সমঝোতা চুক্তি সই করেন ইরান ও সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এপ্রিল ৬, ২০২৩।

সেই সঙ্গে, সৌদি তেলের ওপর আমেরিকার নির্ভরতা কমার সঙ্গে সঙ্গে গত প্রায় দশ বছর ধরে ক্রমাগত দূরত্ব বাড়ছে রিয়াদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সৌদিদের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে  পারমানবিক চুক্তি করেন বারাক ওবামা। ২০১৯ সালে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেলের স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পেছনে ইরানের হাত থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র কিছুই করেনি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা থেকে কিছুটা বাধ্য হয়েই চিরশত্রু ইরানের সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার পথে গেছে সৌদি আরব।

অর্থনীতির প্রয়োজনও সৌদি সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে।

ভিশন ২০৩০ (টুয়েন্টি থার্টি) যুবরাজ মোহামেদ সালমানের এখন ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে নেওয়া তার ঐ উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন পরিকল্পনায় গত ছয় বছরে পশ্চিমাদের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ তিনি পাননি। উপরন্তু ইয়েমেন এবং ইরাক থেকে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা সৌদি আরবের নিরাপত্তা যেভাবে হুমকিতে ফেলেছে তাতে তিনি বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনতে পারছেন না।

‘বিনিয়োগের জন্য যুবরাজ মোহামেদ অস্থির হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তার জন্য তাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে। ফলে, সৌদিরা দুর্বল একটি অবস্থান থেকে ইরানের সাথে এই সমঝোতা করছে,’ বলেন সাদি হামদি।

ইরান কেন আগ্রহী হলো

স্পষ্টতই আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে রেষারেষিতে গত কয়েকবছরে সৌদিদের অনেকটাই চাপে ফেলতে সক্ষম হয়েছে ইরান। তাহলে তারা এই সমঝোতায় কেন রাজী হলো?

অধিকাংশ বিশ্লেষকই বলছেন দেশের ভেতর ক্রমবর্ধমান জনরোষ এবং সেইসঙ্গে বছরের পর বছর ধরে কঠোর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ভঙ্গুর এক অর্থনীতির জেরে ইরানের ইসলামি সরকার প্রচণ্ড চাপে পড়েছে। তাই তারা ভাবছে সৌদি আরব এবং অন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক ঐ দুর্দশা লাঘবে সাহায্য করবে।

সাদি হামদি মনে করেন ইরানের এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটি কৌশলগত উদ্দেশ্যও হয়তো রয়েছে।

সমঝোতা চুক্তি হয়েছে কিন্তু সৌদি-ইরান সম্পর্কে অবিশ্বাস কি তাতে দূর হবে?

‘ইরান মনে করছে সৌদিদের সঙ্গে একটি সমঝোতা হলে লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন বা সিরিয়ায় তাদের যেসব প্রক্সি (সহযোগী) রয়েছে তাদের ওপর চাপ কিছুটা কমবে, এবং সেই সুযোগে তারা তাদের সামরিক এবং রাজনৈতিক অর্জন সংহত করার বাড়তি সময় পাবে।’ 

ফলে, তার মতে, সৌদি আরব আর ইরানের এই সমঝোতা নেহাতই কৌশলগত একটি সন্ধি, এবং দুপক্ষের মধ্যে মৌলিক বিরোধগুলো তাতে ঘুচবে না। রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে তারা সরবে বলে ভরসা নেই হামদির।

সে কারণে, তার মতে, এই বোঝাপড়া মৌলিকভাবে ভঙ্গুর।

গবেষণা সংস্থা কার্নেগী এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ইরান বিশেষজ্ঞ করিম সাজাদপোর তার এক বিশ্লেষণে লিখেছেন বৈরি দেশগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস আর সন্দেহ দূর নাহলে তাদের মধ্যে সমঝোতা যে কোনো সময় ভেস্তে যেতে পারে।

‘১৯৯০ সালে অসলো চুক্তি এবং ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তির যে পরিণতি হয়েছে তাতে এই সমঝোতা চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও সন্দেহের উদ্রেক হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ, সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে পারস্পরিক কোনো বিশ্বাস নেই।’

তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্যে যেভাবে রদবদল ঘটছে মধ্যপ্রাচ্যও তার প্রভাব পড়বেই। এ অঞ্চলের অর্থনীতি এবং নিরাপত্তায় আমেরিকার একচ্ছত্র প্রাধান্য দ্রুত কমছে। আর এর পরিণতিতে, আঞ্চলিক শক্তিগুলোও তাদের চিরাচরিত হিসেব-নিকেশ বদলাতে বাধ্য হচ্ছে।

তাছাড়া, সৌদি আরব-ইরানের সমঝোতায় চীনের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতাও এই সমঝোতাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে বলে অনেক মনে করছেন।

লন্ডনের দৈনিক গার্ডিয়ানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরেশিয়া গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষণা বিভাগের প্রধান আইহাম কামেল বলেন, সৌদি-ইরান বোঝাপড়ার ফল দেখা যাবে খুবই ধীরে।

‘চরম রেষারেষির একটি সম্পর্ক রাতারাতি সহযোগিতার সম্পর্ক হয়ে যায়না। আমি মনে করি ইরান ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সংঘাতময় সম্পর্কটি একধরনের স্বাভাবিক সম্পর্কে রূপ নেবে যেখানে মতভেদ থাকবে, প্রতিযোগিতা থাকবে এবং সেইসঙ্গে সহযোগিতাও হবে।’

ইত্তেফাক/এফএস