একসময়ে রাজনীতিতে নিমগ্ন প্রাণ, ষাটের দশকের বঙ্গবন্ধুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ ও স্নেহের সহযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠার ক্রীড়নক এবং রাজনীতি সচেতন সকলের কাছে দাদাভাই বলিয়া পরিচিত সিরাজুল আলম খান শুক্রবার ৮২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাহার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে অনেকেই একমত না হইলেও বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন সমাজ ছিল তাহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ইহার প্রধানতম কারণ, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্বে ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক যোদ্ধা। ৬ দফা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং তাহারও পূর্বে ছাত্রলীগের একটি অংশের জন্য কায়মনোবাক্যে শ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন তিনি। সেই উত্তাল সময়ে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত। তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালে গঠিত মুজিব বাহিনীর অন্যতম সদস্য। তবে স্বাধীনতা অর্জিত হইবার পর রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে প্র্যাগমাটিজম বা প্রয়োগবাদ সম্পর্কে তাহার যে ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি ছিল; উহা লইয়া হয়তো আলোচনা-সমালোচনা থাকিবে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাহার চিন্তাধারা উগ্রবাদ ও চরমপন্থিদের উত্সাহিত করিয়াছিল কি না সেই প্রশ্নটি হয়তো বারবার উত্থাপিত হইবে। তাহার কোনো কার্যক্রম দ্বারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ক্রান্তিকালে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিব্রত হইবার জন্য সহায়ক হইয়াছিল কি না, তাহাও আলোচনার বিষয় হইতে পারে। এবং উপমহাদেশ সম্পর্কে তাহার যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন তাহা ব্যর্থ হইয়াছে কি না উহাও বিবেচনা করিয়া দেখা যাইতে পারে। তাহার পরও বলিতে হইবে, বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের একটি ইতিহাস হইয়াছিলেন সিরাজুল আলম খান।
দীর্ঘকাল ধরিয়া রাজনীতিতে ‘রহস্যপুরুষ’ বলিয়া বিবেচিত সিরাজুল আলম খান ১৯৬২ সালে স্বাধীনবাংলা বিপ্লবী পরিষদ গড়িয়া তুলিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন, যাহা নিউক্লিয়াস নামে পরিচিত। ১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঐ বছরই কনভোকেশন মুভমেন্টের কারণে তাহাকে গ্রেফতার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি ১৯৭৬ সালে গ্রেফতার হন এবং প্রায় তিন বছর কারাভোগ করেন। সর্বমোট জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি সাত বছর কারাভোগ করিয়াছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করিলেও মূলত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাহার অগাধ পাণ্ডিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাহার লিখিত প্রকাশনা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থায় অন্যদেরকেও চিন্তার খোরাক জুগাইবে।
সিরাজুল আলম খান তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত। কিন্তু নিজের চিন্তা ও আদর্শের প্রতি তার ছিল দৃঢ় নিষ্ঠা। যাহারা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও স্বাধীনতা অবলোকন করিয়াছেন, তাহাদের অন্তরে সিরাজুল আলম খানের চিন্তা প্রোথিত থাকিবে। ষাট দশকের অনেক রাজনৈতিক কর্মী ও পরে জাতীয় নেতা এই সিরাজুল আলম খানের হাতেই ‘তৈরি’ হইয়াছেন। ইহা যেমন সত্য, তেমনি তাহার দর্শন ও আদর্শ বাস্তবায়ন করিতে গিয়া শত শত নেতাকর্মীর জীবন অবসান ঘটিয়াছে—তাহাও সত্য। তাহার পাশাপাশি এই কথাও বলা দরকার, বঙ্গবন্ধু পাশে থাকিয়া যেই সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতা আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, তিনি স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাহার কোনো সুবিধা ভোগ করেন নাই, করিতে চাহেন নাই। আমৃত্যু তিনি প্রায় কপর্দকহীনই ছিলেন। তাহাতে সিরাজুল আলম খানের মর্যাদা, শ্রদ্ধা উপেক্ষিত হয় নাই, বরং নিভৃতে থাকিয়াও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হইয়াছেন। ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের আলীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সিরাজুল আলম খান মৃত্যুর পূর্বে তাহার গ্রামেই শায়িত হইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।