গত ২৫ মে ছয় জন মার্কিন সিনেটরের স্বাক্ষরসংবলিত একটি পিটিশন অনলাইনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে পাঠানো হয়। সিনেটররা হলেন কিথ সেলফ, বব গুড, টিম বার্চেট, ব্যারি মুর, ওয়ারেন ডেভিডসন ও স্কট পেরি। তারা সবাই কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য। চিঠির ঘোষণা দীর্ঘ। বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠীগুলো এই বিবৃতির খসড়া তৈরির জন্য লবিং সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করেছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে বিদেশে অবস্থিত দুটি বাংলা মিডিয়া আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে পরিচালিত এবং একটি বাংলাদেশি সংগঠন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে স্বীকৃত।
এর পেছনে কারা রয়েছে, তা এখন স্পষ্ট। কারণ এই দুটি গোষ্ঠীর নাম সিনেটরদের চিঠিতে রয়েছে। তাদের বেশ কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল আন্তর্জাতিকভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রচারে রত। বিশ্ব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা দেশের সামরিক বাহিনী, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে। ফলস্বরূপ, ছয় জন সিনেটর সরকারের কাছে তাদের অভিযোগগুলো তুলে ধরেন এবং শান্তি মিশনে বাংলাদেশি সেনাসদস্যদের অংশ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের কাছে আবেদন জানান।
বলা বাহুল্য, এই ব্যক্তি ও সংস্থাগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী লবিস্টদের প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে হস্তগত করায় সক্রিয়ভাবে জড়িত। কংগ্রেসম্যানরা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে যে অনুরোধ করেছেন তা হয়তো সেই অর্থ ব্যয় করার পরও তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা হয়তো আনবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কী সিদ্ধান্ত নেবেন বা নেবেন না, তা সম্পূর্ণ তার এক্তিয়ার। বাংলাদেশের নির্বাচনের এখনো ছয়-সাত মাস বাকি।
তবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলো এত অজ্ঞ নয়। বাংলাদেশ শান্তি মিশন এখনো আফ্রিকার অনেক দেশে ভালোভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশ শান্তি মিশনের কার্যক্রম জাতিসংঘের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছে এবং এর সৈন্যরা বেশ কয়েকটি সম্মান অর্জন করেছে। শান্তি মিশনে কাজ করতে গিয়ে আমাদের বেশ কয়েক জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। এটা সবার কাছেই সুবিদিত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জানে। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, লবিস্টরা বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য মার্কিন সরকারকে রাজি করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্টরা অবশ্যই কোনো নির্দিষ্ট কিছু অর্জনের জন্য কাজ করে না।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘শেখ হাসিনার প্রশাসন যেভাবে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে তা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।’ এটা ঠিক, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ভূরাজনীতি পরিবর্তিত হয়েছে। মস্কোর হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। রাশিয়া-চীন এবং পশ্চিমে মার্কিন বন্ধুরা দুটি স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতি অবলম্বনের চেষ্টা করছে।
র্যাবের নিষেধাজ্ঞার পর ছয় জন কংগ্রেসম্যান জো বাইডেনকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানো হয়। চিঠিটি যদি ঐ স্বার্থান্বেষী মহলের নামে লেখা চিঠি হতো, তাহলে কারোই বুঝতে বাকি থাকত না যে, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু চিঠিটি ছয় জন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সঙ্গে জড়িত নয়। চিঠিটি নিঃসন্দেহে গোষ্ঠীস্বার্থে লেখা হয়েছে। আইনপ্রণেতাদের স্বাক্ষরসহ লবিং সংস্থা দ্বারা রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। যে কোনো বাংলাদেশি যিনি চিঠিটি পড়বেন, তারা ধরে নেবেন যে কংগ্রেসম্যানরা ঘটনার প্রকৃত পটভূমি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বা তার আগেও যেসব সমস্যা ছিল, তার সবই বর্তমান সময়ের সমস্যা বলে এই চিঠিতে তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বা তার পূর্বসূরিরা কীভাবে শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসা করেছেন? তারা নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার ওপর গভীর গবেষণা চালিয়েছেন। তবে মার্কিন লবিস্ট থেকে কংগ্রেসম্যানদের কাছে যাওয়া এই চিঠিতে ঠিক বিপরীত কথা বলা হয়েছে। চিঠির ছয় জন প্রতিনিধি এর আগে কখনো বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করেননি। কংগ্রেসম্যানদের বিভ্রান্ত করার প্রয়াসে এই ধরনের ভুয়ো তথ্য ঢোকানো হয়েছে।
বাংলাদেশ, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত একটি দেশ। কংগ্রেস সদস্যদের মাধ্যমে যাওয়া এই চিঠি অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন একটি দাবি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কিছু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশ মানবাধিকারের প্রতি তার অঙ্গীকারের জন্য জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বে প্রশংসিত। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে (ইউএনএইচআরসি) আসন্ন ২০২৩-২০২৫ মেয়াদের জন্য ২০২২ সালের শেষে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে বাংলাদেশ। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় জয়। বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন দেশসহ ১৬০টি দেশের প্রতিনিধিরা মানবাধিকার কাউন্সিলে যোগ দেওয়ার জন্য সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকারের অগ্রগতি ও সংরক্ষণে বাংলাদেশের চলমান প্রচেষ্টা ও অঙ্গীকারকে সর্বাধিক ভোটে মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত করে বিশ্ব সম্প্রদায় স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের এই বিজয় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রিত করার প্রয়াসে কংগ্রেসের সদস্যদের ভুল তথ্য ও প্রচারণা প্রচারের প্রচেষ্টার সম্পূর্ণ বিপরীত। আওয়ামী লীগ সরকার স্বস্তি পেয়েছে এবং বিপুলসংখ্যক ভোটে বিজয়ী হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে সম্মানিত হয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৮৯টি ভোট দিয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও মালদ্বীপ, ভিয়েতনাম এবং কিরগিজস্তানকে এই অঞ্চল থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ষষ্ঠ বারের মতো বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এর আগে ২০০৬, ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতিসংঘের ৪৭ সদস্যের এই গ্রুপে বাংলাদেশ নির্বাচিত হয়েছিল। রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশাসনের মানবিক প্রচেষ্টার ভূয়সী প্রশংসা করেছে বিশ্ব। মানবাধিকার অপরাধের শিকার ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অন্যদিকে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার পর রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার বিষয়টিও মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ফলে বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদানে বাংলাদেশের সহানুভূতি জাতিসংঘসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশাল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ৭৫ বছর বয়সেও জাতিসংঘ শান্তি বজায় রেখেছে এবং বাংলাদেশি ব্লু হেলমেট সহায়তা করছে।
তারা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানের পাশাপাশি এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবকে উন্নত করেছে। ১৯৭১ সালে নিপীড়ন ও অনাচার থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের জলপাই পাতার বাহক বাহিনী জাতীয় ও বৈশ্বিক উভয় স্তরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। গত ২৯ মে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করা বাংলাদেশি সেনাদের ‘সাহস ও নিষ্ঠার’ কথা স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
সুতরাং বাহিনীকে শাস্তি দেওয়া অত্যন্ত অযৌক্তিক হবে। বিশ্বশান্তি ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতি, গৌরব ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের উচিত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদান এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী ফ্রন্টকে শক্তিশালী করতে আরো সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করা। নিষেধাজ্ঞার মানসিকতা অবলম্বনের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র কার্যকর শান্তিরক্ষা মোতায়েন বজায় রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে পারে। এ বিষয়ে বরং সরকারের পক্ষ থেকে লবিং করা উচিত।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সামরিক মিত্র। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাতে আরো বেশি করে একসঙ্গে কাজ করছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে নিয়মিত যৌথ মহড়া পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। মার্কিন ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষ বাহিনীর আদলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এলিট এসডব্লিউএডিএস মেরিন ইউনিটও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় গঠন করা হয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম অবদানকারী দেশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা মিশনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহায়তার কারণে দুর্যোগ মোকাবিলা ও মানবিক সহায়তায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ফাস্ট টহল নৌকা এবং সাবেক মার্কিন কোস্ট গার্ড কাটাররা তাদের ইলেকট্রনিক ও মেকানিক্যাল সিস্টেম আপগ্রেড করেছে, যা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা ও সীমান্ত নিরাপত্তা মিশন, বাংলাদেশ সামরিক ও কোস্ট গার্ড সদস্যদের জন্য কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণ এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় অব্যাহত রয়েছে। সামুদ্রিক ডোমেইন সম্পর্কে বাংলাদেশের বোঝাপড়া এবং নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর প্রচেষ্টা যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে।
লেখক: সিনিয়র গবেষক, সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো, কানাডা