বন্ধু মানে বুকে রঙিন স্বপ্ন আর হাতে হাজারো ফুলের ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর, যার মন হবে আকাশের মতো বিশাল, যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। বন্ধু মানে, নিজে এক বুক কষ্ট ধারণ করা সত্ত্বেও সর্বদা অন্য বন্ধুকে হাসিখুশি রাখার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা। বন্ধু মানে—বাঁধভাঙার গান; বন্ধু মানে—দুই দেহে এক প্রাণ। বন্ধু মানে—সামান্য দর্শনের আশায় দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো। বন্ধু মানে—দিনের বেলায় কোনো কারণে মারামারি করা সত্ত্বেও রাতে কল দিয়ে জিগ্যেস করা, কিরে খাওয়াদাওয়া করছিস?
তাহলে বন্ধুত্ব কী? কোন ধরনের ব্যক্তি স্বার্থ ছাড়া দুই জন ব্যক্তির মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা-ই আমার মতে বন্ধুত্ব, যারা একে অপরকে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা দূরে রেখে সর্বদা সহনশীল ও সহযোগিতামূলক আচরণ করে যাবে। শুধু তা-ই নয়, এই বন্ধুত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ‘আমাদের রহস্যময়তার পরীক্ষণে প্রাপ্ত সবচেয়ে সৌন্দর্যময় জিনিসগুলো হলো শিল্প, বিজ্ঞান এবং বন্ধুত্ব।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থকে বুঝায়, দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগত্। অর্থাত্ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের সকল কাজ সম্পন্ন করিবে।’
প্রখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, ‘বন্ধুত্ব গড়তে ধীর গতির হও; কিন্তু বন্ধুত্ব একবার হয়ে গেলে, প্রতিনিয়তই তার পরিচর্যা কর।’ এভাবে কবি-দার্শনিকদের মতামত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বন্ধুত্ব ছাড়া জীবন অসহায় এক মরুভূমির মতো। যেখানে শূন্যতা আর হাহাকার ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বন্ধু ছাড়া নিঃসঙ্গ একাকী জীবন হতে পারে, আত্মহত্যার ও মাদকাসক্তের প্রধান ধারক-বাহক। তাই আমাদের এই স্বল্পজীবনে বন্ধু থাকা একান্ত আবশ্যক বলে আমি মনে করি। তবে সে বন্ধু হতে হবে মনের মতো: সৎ, মহৎ, নিষ্ঠাবান ও সহযোগিতামূলক। তখনই আমরা তাকে প্রকৃত বন্ধুর গুণে গুণান্বিত বলে বিবেচনা করতে পারব।
আসুন, আমরা প্রকৃত বন্ধু খুঁজে বের করি, আর এই বন্ধু খোঁজার জন্য আমাদেরকে মহাদেশ তথা মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমরা আমাদের চলার পথে অনেককেই বন্ধু বা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পাশে পাই, তবে সবাই কি প্রকৃত বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা রাখে? কেউ কেউ হয়তো-বা রাখেন; কিন্তু অনেকেই রাখেন না। আর প্রকৃত বন্ধু তো সে, যাকে আয়না বা ছায়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়, যার সামনে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে নতুন রূপে প্রকাশ করা যায় এবং যে কখনো বিপদের মুখে বন্ধুকে একা রেখে পিছু ছেড়ে পালিয়ে যায় না। প্রকৃত বন্ধু তো সে, যে বন্ধু যা বলবে তাই গভীর মনোযোগের সঙ্গে মনোমুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করবে। প্রকৃত বন্ধু সে, যে আপনি মোবাইল ফোনের এপার থেকে মন খারাপ করেছেন ওপার থেকে আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সে বলবে আয় একসঙ্গে আড্ডা দিয়ে তোর অবুঝ মনটা ভালো করে দিই। সেই তো প্রকৃত বন্ধু, যে আপনাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় না খাইয়ে নিজে কখনো খাবে না এবং সর্বদা আপনার মঙ্গল কামনা করবে। এ ধরনের মহত্ মানুষকেই আমরা প্রকৃত বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। তাহলে মেকি বা খারাপ বন্ধু হিসেবে কাদেরকে চিহ্নিত করা যায়? আমরা আমাদের বন্ধু মহলের মধ্যে কিছু বন্ধু পাব, যারা শত ভুল করা সত্ত্বেও নিজেদের ভুল স্বীকার করতে চায় না, এমনকি একটি বারের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করে না, বরং এই দুঃখ প্রকাশ না করাকে তারা তাদের ক্রেডিট মনে করে, শুধু তাই নয়, বন্ধু মহলের মধ্যে ঘটে যাওয়া যে কোনো ধরনের অঘটন থেকে তারা নিজেকে সর্বদা দূরে রাখার চেষ্টা করে এবং বন্ধুদের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেদের মতামত না থাকলে, ঐ সিদ্ধান্ত তারা কখনো মেনে নিতে চায় না। এটাও দৃশ্যমান, তারা অন্য বন্ধুদের দুর্বল জায়গা না থাকা সত্ত্বেও সারাক্ষণ খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা করে এবং অপমানজনক কথা শুনাতে সর্বদা তত্পর থাকে।
তাই আমাদের প্রত্যেককে অন্যদের ভালো বন্ধু হওয়ার পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ব ও সহনশীলতা জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে এ নিষ্ঠুর পৃথিবীকে ভালোবাসার আগলে আটকে রাখতে হবে। অন্যথায় এই বন্ধুহীন নিঃসঙ্গতা ও মেকি বন্ধু মহলের সংস্পর্শতায় মাদকাসক্ত, অরাজকতা, হত্যা, লুটতরাজ, গুম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সিট-বাণিজ্য, অন্যের হয়ে ভর্তি বা চাকরি পরীক্ষায় প্রক্সি দেওয়া, মিথ্যা মামলায় হয়রানির মতো ইত্যাদি নানা ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়