একসময় বষার্কালকে ডেঙ্গু রোগের আড়ত বলা হলেও এখন সারা বছর ডেঙ্গুর মৌসুম। বছর জুড়ে বংশবিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও আশ্রয়স্থল সহজে খুঁজে পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়ে ডেঙ্গু বারোমাসি রোগের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। এডিস মশা এই রোগের বাহক হয়ে পানির মধ্যে ডিম পেড়ে ও ছানা ফুটিয়ে মানুষের বসতবাড়ি, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, রাস্তাঘাট, যানবাহন, হোটেল-রেস্টুরেন্ট সবকিছুতেই অতি সহজে তাদের বিচরণক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে।
এডিসের দাপট এখন সব জায়গায়। দেশের ৬৪ জেলার সবগুলোতে এরা সংক্রমণ ছড়িয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এরা প্রাণঘাতী। দেশে এদের হুলের বিষে তথা সংক্রমণে দিনে দিনে মৃত্যুর রেকর্ড বেড়ে চলেছে। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী জনস্বাস্থ্যের জন্য ডেঙ্গু একটি বড় হুমকি হিসেবে আবিভূর্ত হয়েছে। তাই মানুষ খুব উদ্বিগ্ন হয়ে এক অজানা ভীতির মধ্যে বাস করছে।
অন্যদিকে ডেঙ্গু সংক্রমণ ক্রমাগত বিস্তার লাভ করায় ডেঙ্গু চিকিত্সা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। সারা দেশের মুমূর্ষু ডেঙ্গু রোগীরা উন্নত চিকিত্সা নিয়ে জীবন বাঁচানোর আশায় রাজধানী ঢাকায় ছুটে আসছে। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বেড খালি নেই। মেঝেতে শুয়ে রেখেও চিকিত্সার স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক রোগি হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে সারা ঢাকা শহরে। এতে মৃত্যুর সংখা আরো বেড়ে যাচ্ছে।
গতকাল ইত্তেফাকের খবর, ডেঙ্গুতে এক দিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার ২৯৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে ৯ জন। গত বছর যেখানে মোট ১৮১ জন মারা যায়, সেখানে এ বছর তা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৫ জনে। এছাড়া ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্যে গরমিল নিয়ে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। রাজধানীর মুগদা এলাকার আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে গত কয়েক দিনে ৩০ জন ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুবরণ করলেও হিসাবের তালিকায় ২৫ জনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে রোগীর আত্মীয়স্বজন অভিযোগ করেছেন। শিশু, বয়স্ক ছাড়াও ১৮ থেকে ৪০ বছরের রোগীরা এ বছর বেশি ভর্তি হচ্ছে।
আমাদের দেশে প্রতি বছর ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে চলেছে। এ দেশে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৭৯ জন মারা গিয়েছিলেন। এবার নতুন ভেরিয়েন্টের কারণে ডেঙ্গু সংক্রমণের প্রবণতা খুব বেশি। কারণ ডেঙ্গুর এই নতুন ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকার মাধ্যমে চিকিত্সাব্যবস্থা এখনো শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। উল্লেখ্য, ডেঙ্গু একটি হাজার বছর আগের প্রাচীন রোগ। চীনে ৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে এই রোগ শনাক্ত করা হয়েছিল বলে তাদের প্রাচীন নথিপত্রে জানা যায়। এই জ্বরকে শনাক্ত ও ডেঙ্গু জ্বর বলে নামকরণ করা হয় ১৯৭৯ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন বলেছে, আঠারো ও উনিশ শতকের দিকে বিশ্বব্যাপী জাহাজশিল্পের প্রসার ও সমুদ্রবন্দরের ব্যবহার বাড়তে থাকলে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী ভেক্টর ও এডিস ইজিপ্টি ছড়ানোর মতো আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়। তবে ১৭৭৯ সালে প্রথম ডেঙ্গু রোগ ধরা পড়লেও তখন এর এতটা ভয়াবহাতা ছিল না বিধায় চিকিত্সা নিয়ে মাথা ঘামানো হয়নি। পরে গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও ভয়াবহতা বিবেচনায় এই রোগ প্রতিরোধে টিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। সেই সব টিকা দুই-এক ধরনের লক্ষণে কার্যকর ছিল। বর্তমান ডেঙ্গুর চারটি ভেরিয়েন্ট সক্রিয় রয়েছে। এসব ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে আমাদের দেশজ ডেঙ্গু চিকিত্সার গাইডলাইন হালনাগাদ নয়।
আমাদের দেশে ডেঙ্গুর বর্তমান ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে ব্যবহূত ওষুধের সঠিক কার্যকারিতা গবেষকদের জানা নেই। এজন্য এখনো গবেষণা চলছে। তাই টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ঝামেলা রয়েছে। এছাড়া পরিবেশের ভিন্নতাভেদে ডেঙ্গু ভেরিয়েন্টের ভিন্নতা লক্ষণীয় হওয়ায় আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে নতুনভাবে টিকা তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।
ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিসকে বলা হয় গৃহপালিত মশা। অ্যানোফিলিস, কিউলেক্স মশা ঝোপঝাড়ে থাকলেও এডিসরা মানুষের কাছে ঘরে, বসতবাড়ির আশপাশে বাস করতে পছন্দ করে। বাড়ির পাশের নালা, ডোবা, পানির ট্যাংক, মসজিদের খোলা চৌবাচ্চা, অব্যবহূত মাছের অ্যাকুরিয়াম, ছাদবাগানে, বারান্দায় বা ঘরের ভেতরে পাত্রে বা ফুলের টবে, গাড়ির টায়ারে, ডাবের খোসায়, খুকুর পরিত্যক্ত খেলনায় তিন-চার দিনের বেশি জমে থাকা পানিতে সুযোগ পেলেই এডিস মশা ডিম পাড়ে। আমাদের দেশে ছাদবাগান তৈরি করে অনেকে অযত্ন, অবহেলায় প্লাস্টিকের টবসহ বিভিন্ন পাত্রসামগ্রী ফেলে রেখেছেন। শুধু বষার্কালে নয়, পানির পাইপে লিক থাকা, অসচেতনতা ও বিভিন্ন কারণে সারা বছর সেগুলোতে পানি জমে থাকার সুযোগ পায়। সব শৌখিন ছাদবাগান মালিককে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে অতি সচেতন হতে হবে।
তবে বর্তমানে ঢাকাসহ বড় বড় শহরে ডেঙ্গু সংক্রমণের সবচেয়ে বড় কারণ হলো সারা বছর নির্মাণকাজ চালানো। নির্মাণকাজে পানির ব্যবহার বেশি। খোলা ট্যাংক, ড্রাম, বালতি, পাইপ ইত্যাদিতে দীর্ঘদিন পানি জমিয়ে রেখে নির্মাণকাজ চালানো হয়। মজার ব্যাপার হলো, এত দিন বলা হতো, এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম পাড়ে। এখন জানা গেছে, ওরা পরিষ্কার, ময়লা, নোনা, ঠান্ডা, গরম সব পানিতেই ডিম পাড়ে। উপযুক্ত পরিবেশ না পেলে সেই ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে মাসের পর মাস দেরি হতে পারে। তাই কোথাও অহেতুক খোলা পানি জমিয়ে রাখা বিপজ্জনক।
এই মুহূর্তে আমাদের দেশে ডেঙ্গু ‘এন্ডেমিক’ বা স্থানীয় চরিত্র ধারণ করে জনমনে ভয়বহতা ছড়াচ্ছে। তবে সংক্রমণ ও মৃত্যুর এই ঊর্ধ্বগতির হার চলতে থাকলে অচিরেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ‘প্যান্ডেমিক’ বা সমগ্র দেশে বড় মহামারির রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সামনে তেমন কোনো পরিস্থিতি দেখা দিলে হাসপাতালগুলোতে করোনার মতো বিশেষ শয্যার ব্যবস্থা তৈরির মাধ্যমে ডেঙ্গু মোকাবিলায় বিষেশায়িত চিকিত্সাসেবা চালু করে জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি এখনই নিতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু, বয়স্ক, কিডনি-হার্ট-লিভারের রোগীকে ঘরে বসিয়ে রাখলে ‘শকড্ সিনড্রোম’ সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। এটাতে অঘটন ঘটতে পারে।
দেশের গ্রামাঞ্চলের কম্যুনিটি হাসপাতালগুলো কাজের অভাবে বেশির ভাগ সময় দরজা বন্ধ করে রাখে। রাজধানীকেন্দ্রিক চিকিত্সাসেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে এসব কম্যুনিটি হাসপাতালের কর্মীদের মটিভেশনাল কর্মসূচি নিয়ে মানুষকে ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য ডেঙ্গু যেহেতু একটি বড় হুমকি, সেহেতু দ্রুত ডেঙ্গুর প্রতিশেধক বা টিকা আবিষ্কারের জন্য তত্পর হতে হবে।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন