সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫, ২ আষাঢ় ১৪৩২
The Daily Ittefaq

২ বছরে বৃষ্টিপাত কমেছে ৬০ ভাগ

ভরা বর্ষায় খরায় পুড়ছে রাজশাহী 

আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২৩, ১৭:১৫

দুই বছর আগে বর্ষাকালে রাজশাহীতে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, গতবছর ও চলতি (২০২২-২০২৩) বছর মিলিয়ে সেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত এখনো রাজশাহীতে হয়নি। ফলে শ্রাবণেও প্রকৃতি হয়ে উঠেছে রুক্ষ। খাল-বিল, নদী-নালা সবকিছুই পানি শূন্যতায় ভুগছে। ফসলের মাঠে বিরাজ করছে পানির জন্য হাহাকার। এই ভরা বর্ষাতেও রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলের গভীর নলকূপ থেকে প্রতিদিন পানি সেচ দিতে হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ৫০-৬০ ভাগ বৃষ্টিপাত কমেছে। এবার বৃষ্টিপাত আরও কমে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ভরা বর্ষাতেও চৈত্র মাসের মত খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এতে রোপা আমনের আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছে না কৃষকেরা। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় আমনের চারা রোপণ করা যাচ্ছে না। আবার যেসব জমিতে ইতোমধ্যে আমনের ধানের চারা রোপণ করা হয়েছিল, সেসব জমির ধানগাছ পানির অভাবে মরে যাচ্ছে। কৃষকরা বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপ থেকে পানি সেচ দিয়ে ধানগাছ বাঁচিয়ে রাখছেন। ধানের উৎপাদনও এবার ব্যাহত হবে বলে আশংকা করছেন কৃষকরা।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্র মতে, চলতি বছর রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৯৬ দশমিক ৭ মিলিমিটার। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩৮ দশমিক ৩ মিলিমিটার, জুনে ৮৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার, মে মাসে ১০৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার, এপ্রিলে ৪৮ দশমিক ৮ মিলিমিটার ও মার্চে ২১ দশমিক ৫ মিলিমিটার। সূত্র মতে, গতবছর জুলাই পর্যন্ত রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৩৬৬ মিলিমিটার। এর মধ্যে জুলাইয়ে ৫৯ এবং জুনে ৭০ দশমিক ২ মিলিমিটার।

তবে ২০২১ সালে জুলাই পর্যন্ত রাজশাহীতে ৮৫২ দশমিক ৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এর মধ্যে জুলাইয়ে ৩৩৮ দশমিক ১ মিলিমিটার, জুনে ২৬২ দশমিক ৩ মিলিমিটার, মে মাসে ২৩৭ দশমকি ২ মিলিমিটার ও এপ্রিলে ১৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার। ওই বছর গোটা বর্ষায় ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয় রাজশাহীতে। কিন্তু গত দুইবছর মিলেও সেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়নি। গতবছর আর চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৬২ দশমিক ৭ মিলিমিটার। যা ২০২১ সালের তিন মাসে হয়েছিল ৮৩৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার।

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পানির অভাবে জমিতে পাট কাটতে পারছেন না। পাট কাটার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জাগ দেওয়ার পানি না থাকায় পাট কাটতে পারছি না। এতে পাটের ফলনও ভালো হবে না, আবার পাট কাটতে না পারায় ওই জমিতে আমন ধানও লাগাতে পারবো না। ইতোমধ্যে যারা ধানের চারা রোপণ করেছেন, তাদের জমির ধানও খরায় নষ্ট হচ্ছে। ধান বাচাতে জমিতে ডিপটিউবওয়েল দিয়ে পানি দিতে হচ্ছে। কিন্তু ঠিকমতো বিদ্যুৎ না থাকায় ডিপ চালানো যাচ্ছে না। ভরা বর্ষায় এমন পানির সঙ্কট কখনো আগে দেখিনি।’

পবা উপজেলার চৈতন্যপুর এলাকার কৃষক আমজাদ আলী বলেন, মাস খানেক আগে জমিতে আমনের চারা রোপণ করেছি। এখন পানির অভাবে প্রতিদিন সেচ দিতে হচ্ছে। সময়মত সেচ না দিলে জমি ফেটে যাচ্ছে। তিনি বলেন,  আগে শ্রাবণে দিনের পর দিন বৃষ্টি দেখেছি। এখন শ্রাবণেই চৈত মাসের খরা দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়ার এতো পরিবর্তন ভাবাই যায় না।’

রাজশাহীর ইতিহাস গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘টানা ৪-৫ দিন বৃষ্টিপাত তো আর দেখি না। ১৫-২০ বছর আগেও আমরা বর্ষায় টানা কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাত দেখেছি। সারাদিন শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরেছে। ঘর থেকে বের হওয়া যায়নি। রাস্তা-ঘাট পানিতে টইটুম্বুর থাকতো। এখন তো টানা একদিনও বৃষ্টিপাত চোখে পড়ে না। এর ফলে এখন শ্রাবনেও খরায় পুড়ছে রাজশাহী অঞ্চল। এটি আমাদের জন্য মারাত্মক অশনি সঙ্কেত। গঙ্গার উজানে ভারত পদ্মার বাঁধ দিয়ে পানি ফসল চাষে ব্যবহার করছে। গঙ্গার (পদ্মা) পানি বেশির ভাগ নিয়ে নিচ্ছে ভারত। এতে করে এই অ ল আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে। যার বিরূপ ফল আমাদের পোহাতে হচ্ছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। গত দুই বছরে রাজশাহীতে অন্তত ৫০-৬০ ভাগ বৃষ্টিপাত কমেছে। জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনের ফলে এটি হয়েছে। উষ্ণায়ন থেকে উষ্ণায়নের দিকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ।’

রাজশাহী কৃষি বিভাগের উপসহকারী কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, ‘রাজশাহীতে এবার আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে। ইতোমধ্যে ৬০ ভাগ জমিতে ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। এখনো সময় আছে। বাকি জমিতে আমন চাষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৃষ্টিপাত না থাকায় আমনের জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। পানির অভাবে কৃষকরা পাট জাগ দিতে পারছে না। তবে বারনইসহ ছোট ছোট নদীতে পাট জাগ দিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের।’ তিনি আরও জানান, এবার ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। ইতোমধ্যে ৬৫ ভাগ জমির পাট কাটা হয়েছে। 

ইত্তেফাক/এআই