মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ডেঙ্গু: প্রয়োজন মানসম্পন্ন গবেষণা

আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০৮:১০

দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি লইয়া উদ্বেগ কিছুতেই কাটিতেছে না। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা দিনদিন বাড়িয়াই চলিয়াছে। গতকাল প্রকাশিত পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে ৯ দিনেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হইয়াছে ১০১ জনের। এই বত্সর মোট মৃত্যু দাঁড়াইল ৩৫২ জনে। রেকর্ডসংখ্যক আক্রান্তের ও মৃত্যুর পর সংখ্যা বাড়িতেছেই। পরিস্থিতি লইয়া সকলের উৎকণ্ঠা থাকিলেও মশক নিধন কার্যক্রম তেমন গতিশীল নহে। এই ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রধান ভরসা মশারি, মশার কয়েল, অ্যারোসলসহ বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক সামগ্রী। কিন্তু মশার কীটনাশক প্রতিরোধী হইয়া উঠা কিংবা ভেজাল কীটনাশকের কারণে এই সকল প্রয়োগ করিয়াও যখন মশক নিধন করা যাইতেছে না, তখন উপায় কী?

যুক্তরাজ্যের পেস্ট ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘ইনসেকটিসাইড রেজিস্ট্যান্স কমপ্রোমাইসেস দ্য কন্ট্রোল অব এডিস এজেপ্টি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে যেই সকল বোতলজাত মশানাশক ব্যবহার করা হয়, সেইগুলো ততটা কার্যকর নহে। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা সেই সকল কীটনাশক প্রতিরোধী হইয়া উঠিতেছে। রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও, মিরপুর, উত্তরা, ধানমন্ডি ও বসুন্ধরা এলাকার এডিস মশার ডিম সংগ্রহপূর্বক পরীক্ষাগারে ডিম হইতে উত্পন্ন তিন হইতে পাঁচ দিন বয়সি রক্ত না খাওয়া স্ত্রী মশার ওপর অ্যারোসল স্প্রে করিয়া দেখিতে পাওয়া যায়, ৭৪ শতাংশ পর্যন্ত উড়ন্ত ও বিশ্রাম নেওয়া মশা বাঁচিয়া থাকিতেছে। তাহারা নিস্তেজ হইতেছে না বা মারা যাইতেছে না। ইহা ছাড়া সিটি করপোরেশন মশার বংশ নির্মূলে লার্ভা ধ্বংসের জন্য যেই সকল ঔষধ ব্যবহার করে, সেইখানেও ভেজাল রহিয়াছে বলিয়া ইহার আগে বহু রিপোর্ট প্রকাশিত হইয়াছে পত্রপত্রিকায়। এইভাবে মশার ওপর মশানাশকের কার্যকারিতা লইয়া প্রশ্ন দেখা দিলে সাধারণ মানুষ যাইবে কোথায়? তাহারা অর্থ খরচ করিয়াও মশার জ্বালাতন ও ইহার ক্ষতিকর প্রভাব হইতে পরিত্রাণ লাভ করিতেছেন না।

কীটতত্ত্ববিজ্ঞানীরা বলিতেছেন, আমাদের দেশে সাধারণত ৪৩ হইতে ৪৫ প্রজাতির মশার অস্তিত্ব রহিয়াছে। এখানে তাপমাত্রা ২৭-৩২ ডিগ্রিতে পৌঁছাইলেই তাহা মশা-মাছি বা অন্যান্য পোকামাকড়ের জন্য প্রজননবান্ধব হইয়া উঠে। বর্ষাকালে এই প্রজননের মাত্রা বাড়িয়া যায়। বর্ষার ধরন অস্বাভাবিক হইলে তাহা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে আমাদের দক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাব বিদ্যমান। কখন, কোথায় ও কীভাবে এইসব ঔষধ প্রয়োগ করিতে হইবে, তাহা সঠিকভাবে করিতে হইলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। একইভাবে বাজারে যেই সকল তরল কীটনাশক পাওয়া যায়, তাহার কার্যকারিতা লইয়া ঘনঘন পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়া দেখিতে হইবে। এই জন্য সার্বিকভাবে গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও সিটি করপোরেশনে আরো কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগের বিকল্প নাই। কীটনাশকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া লইয়াও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে মশা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন ধরিয়া ঘরে ঘরে যে স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করা হইতেছে, তাহাতে সাধারণত পারমেথ্রিন, বায়ো-অ্যালোথ্রিন, ডি-ট্রান্স অ্যালোথ্রিন, টেট্রাথ্রিন, ডেলটামেথ্রিন, বায়োলেথ্রিন, মেটোফলুথ্রিন, সাইপারমেথ্রিন, ইমিপোথ্রিন, ডায়াজনিনসহ আরো কিছু উপাদান থাকে। এইগুলি মূলত উড়ন্ত মশার ক্ষেত্রে কাজ করিয়া থাকে। লার্ভা নিরোধে ইহার কোনো ভূমিকা নাই বলিয়া মশার বংশ নির্বংশ হইতেছে না। ২০১৭ সাল হইতেই গবেষকরা বলিয়া আসিতেছেন যে, মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হইয়া উঠিতেছে। কিন্তু ইহা কেহই আমলে নিতেছেন না। বরং আগের পদ্ধতিতে কাজ করিতেছেন বলিয়া মশক নিধনে আশানুরূপ সাফল্য পাওয়া যাইতেছে না। এই জন্য ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর মশা নির্মূলে গবেষণা কার্যক্রম না বাড়াইলে প্রচলিত পদ্ধতিতে মশা মারিতে কামান দাগাইয়াও তেমন কোনো লাভ হইবে না। ডিসকভার ওয়াইল্ড লাইফের জরিপ অনুযায়ী পৃথিবীতে ডেডলিয়েস্ট বা সর্বোচ্চ ঘাতক প্রাণী হইল মশা। মশার দ্বারা সারা পৃথিবীতে প্রতি বৎসর মৃত্যু হয় ৭,২৫,০০০ হইতে ১০,০০,০০০ মানুষের। অতএব মশা হইতে রক্ষায় অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড উভয় ক্ষেত্রেই গবেষণা বাড়াইতে হইবে। অনুকূল পরিবেশের ফলে মশার জিনগত ও শারীরবৃত্তীয় যে পরিবর্তন হইয়াছে, তাহার বিপরীতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ঠিক রাখিয়া জৈবিক দমন ও যুক্তিযুক্ত কীটনাশকের ব্যবহার প্রয়োজন।

ইত্তেফাক/এসটিএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন