বৃহস্পতিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বিপর্যয়ের পথে নাইক্ষ্যংছড়ির ‘সাদা সোনা’ খ্যাত রাবার শিল্প

আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১৫:২৬

রাবার শিল্প নগরী হিসেবে খ্যাত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীতে স্বাধীনতা পরবর্তী আশির দশকে ‘সাদা সোনা’ খ্যাত রাবার শিল্পে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এতে করে ১২ হাজার শ্রমিকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাবার শিল্প এখন ধ্বংসের প্রায় দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। আশির দশকে রাবারের চাহিদা ও যোগানের সমতা, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, উদ্যোক্তাদের আগ্রহ রাবার চাষ প্রকল্প বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। রয়েছে শত শত ব্যক্তি মালিকানাধীন রাবার বাগান।

বিগত দিনে দেশের মাটিতে সাদা সোনার বিপ্লব ঘটলেও এখন সাদা সোনার দরপতনের কারণে রাবার শিল্প বর্তমানে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। রপ্তানির সুযোগ থাকলেও বিদেশ থেকে রাবার আমদানির এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন রাবার বাগান মালিকরা সস্তা দরে শিট বিক্রি করায় দেশীয় উৎপাদিত রাবারের বাজার দর এখন কমে গেছে। এর ফলে রাবার চাষীদের পারিশ্রমিক ও লভ্যাংশ দেওয়ায় বন্ধ থাকায় যে কোনো সময় উৎপাদন বন্ধের আশঙ্কা দেখে দিয়েছে।

দেশীয় উৎপাদিত রাবারের বাজার দর এখন কমে গেছে। ছবি: ইত্তেফাক

রাবার বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সাল থেকে তিন দফায় বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির প্রায় ১৩ হাজার একর পাহাড়ি ভূমিকে রাবার চাষ প্রকল্পের আওতায় নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে তিন হাজার ৩০০ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী  জুম্মু পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। উঁচু ভূমি বন্দোবস্তীকরণ প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) অর্থায়নে বান্দরবান জেলায় পরিবার পিছু পাঁচ একর ২৫ শতক করে এক হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। তাদের মাধ্যমে প্রতি মাসে ১২০ মেট্টিক টন প্রক্রিয়াজাত রাবার শিট উৎপাদন করে বছরে ৪০ কোটি টাকার রাবার বিক্রি করা হচ্ছিল। বর্তমানে ১৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয় করে উৎপাদিত একই পরিমাণ রাবার বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১৬ কোটি টাকায়।

বান্দরবানের বাইশারীসহ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট ও টাঙ্গাইলের মধুপুরে রাবার বাগান রয়েছে। তবে দেশের সব চাইতে বেশি রাবার চাষ রয়েছে বান্দরবানের বাইশারীতে।

রাবার বোর্ড জানায়, বর্তমানে বাইশারীতে ব্যক্তি মালিকানা ও ঘরোয়া বাগান মিলে আনুমানিক ১৫ হাজার একরের অধিক পরিমাণ রাবার বাগান রয়েছে। উক্ত বাগানগুলোতে প্রায় ১২ হাজারের অধিক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। গত কয়েক বছর বিদেশি থেকে আমদানির ফলে রাবারের দাম একেবারেই নিচে নেমে গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশীয় পণ্যের বাজারজাত করে দেশ ও শ্রমিকদের বাঁচানো সম্ভব। তাই রাবার সেক্টরের প্রতি সরকারের নজর দিয়ে রাবারের দাম বাড়িয়ে এ শিল্পকে চলমান রাখতে সরকারের প্রতি দাবি জানান সচেতন মহল। 

বাগান মালিকদের অভিযোগ,  ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতি কেজি রাবার বিক্রি হয়েছে ৩০০-৩৮০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমানে বাজার দর পতনে প্রতি কেজি রাবার বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১৪০-১৪৫ টাকা দরে। আচমকা দরপতনে রাবার মালিকেরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। বর্তমান অবস্থায় বাজারে দর পতনের কারণে উৎপাদিত রাবার বিক্রি করে শ্রমিকদের মাসিক বেতন ভাতা পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

গাছ থেকে সংগ্রহ করা তরল রাবার। ছবি: ইত্তেফাক

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, একটি মহল নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশীয় পণ্যকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে বিদেশি পণ্য আমদানি করে বাজার সয়লাব করেছে। অথচ রাবারের দরপতন হলেও রাবার থেকে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর কোনো ধরনের দাম কমে নাই। বাজারে বর্তমানে রাবার থেকে উৎপাদিত পণ্যের দাম এখনো চড়া।

রাবারের দাম নিয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যবসায়ীরা ও রবার বাগান মালিকরা দেশীয় এ শিল্পকে বাঁচানোর জন্য শিল্প ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

পিএইচপি ল্যাটেক্স অ্যান্ড রাবার প্রোডাক্ট লিমিটেডের সিনিয়র ব্যবস্থাপক আমিনুল হক আবুল বলেন, তাদের বাগানে বর্তমানে নিয়মিত অনিয়মিত মিলে পাঁচ শতাধিক শ্রমিক কাজ করছেন। গত মাসের উৎপাদিত রাবার বিক্রি করে শ্রমিকদের বেতনন পরিশোধ করতে কষ্ট হয়েছে।  এই অবস্থায় চলতে থাকলে বাগান মালিকেরা উৎপাদন বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে। এখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে পড়েছে যা এ শিল্পকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

নাজমা খাতুন রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক আল আমিন বলেন, বর্তমানে উৎপাদিত রাবার পণ্যও বিক্রি হচ্ছে না। গত মাসের উৎপাদিত রাবার এখনো গুদামে মজুদ রয়েছে।

বাংলাদেশ রাবার বাগান মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মো. আলাউদ্দিন বলেন, নামমাত্র আমদানি শুল্ক বসানোর কারণে আমদানিকারকেরা বিদেশ থেকে চাহিদার তুলনায় বেশি রাবার আমদানি করছে। ফলে দেশীয় রাবারের চাহিদা কমে যাচ্ছে।

ছবি: ইত্তেফাক

কৃষিপণ্য হলেও শুকনো রাবার বেচার সময় সরকারকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও চার শতাংশ আয়কর পরিশোধ বাধ্যতামূলক করেছে। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত বর্তমানে রাবার শিল্পের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তাই ১৯৬০ সাল থেকে টিকে থাকা এ শিল্পকে বাঁচাতে আমদানি শুল্ক বাড়ানো এবং রাবারের ওপর ভ্যাট ও আয়কর প্রত্যাহার করার দাবি জানান তিনি।

স্থানীয়দের দাবি, রাবার সেক্টর বন্ধ হলে শ্রমিকদের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করেন।

 

ইত্তেফাক/আরএজে