বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

চোরের মায়ের কেন বড় গলা?

আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৩০

কথায় আছে—‘চোরের মায়ের বড় গলা/ নিত্য দেখায় ছলাকলা,/ চোরকে নিয়ে বড়াই করে/ চোরের জন্য লড়াই করে।’ প্রশ্ন হইল চোরের মায়ের কেন বড় গলা? কথাটি কোথা হইতে আসিল? কেন আসিল? ইহার মানে কী? এই প্রবাদে কে চোর? কে তাহার মা?

এই প্রবাদটির ‘উৎস’ অনুসন্ধানে জানা যায়, হনুলুলুতে বাস করিত এক চোর। সেই চোর মনে করিতেন—চুরি হইতেছে একধরনের শিল্প, ইটস অ্যান আর্ট। সেই চোরের মা বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করিতেন। চোরের মায়ের জীবনের অন্যতম শখ ছিল—গলাভর্তি গয়না পরা। সেই শখ পূরণ করিতেই ছেলে তাহাকে প্রতি মাসে টাকাপয়সা ছাড়াও একটা করিয়া নেকলেস পাঠাইত। এইভাবে চোরের মায়ের গলাভর্তি গয়নায় ভরিয়া গেল। তাহার বড় গলা ভরা গয়না দেখিয়া গ্রামের সকলেই বলিত ‘বড় গলাওয়ালা মা।’ এমন সময় কোথাও চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িল তাহার ছেলে। আইনের লোক তাহার মাকে খুঁজিতে গিয়া জানিতে পারিল—এই এলাকায় চোরের মাকে কেহ চেনেন না। তবে ‘বড় গলাওয়ালা মা’ বলিতেই সকলে চিনিয়া ফেলিল। সেই হইতে নাকি বাংলাদেশে এক নূতন প্রবাদের জন্ম হইল—‘চোরের মায়ের বড় গলা’। আবার অনেকে বলেন—ইহা আসলে কেমোফ্লেজ। এই ধারণাটি আসিয়াছে রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’তে প্রকাশিত ‘সন্দেহের কারণ’ কাপলেট হইতে। তাহা হইল—‘কত বড়ো আমি, কহে নকল হীরাটি।—/ তাই তো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।’

আসলে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ চোরের বা চুরির বিপক্ষে। নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ, যুক্তি, আইন—কোনো কিছুই চোর বা চুরির পক্ষে কথা বলে না। সেই ক্ষেত্রে গলা বা গলাবাজিই হয় চোর বা চোরের আত্মীয়স্বজনের একমাত্র ভরসা। নিজেদের অপরাধ ঢাকিতে তাহাদের উচ্চৈঃস্বরে চ্যাঁচাইতে হয়। নিজে যে ভালো, তাহা চ্যাঁচাইয়া জানাইতে হয়। গলা ছাড়া চোর বা চোরের মায়ের আসলে অন্য কোনো অবলম্বন নাই। কাজেই যাহারা চড়া গলায় কথা বলেন—তাহাদের সাধুতা লইয়া প্রশ্ন জাগে, যেমনটি কণিকায় বলিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চোর লইয়া আমাদের দেশে অনেক রকম প্রবাদ-প্রবচন রহিয়াছে। ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ ছাড়াও আমরা উদাহরণস্বরূপ বলিতে পারি—‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’, ‘চোরের সাক্ষী মাতাল’, ‘যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর’, ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’, ‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা’, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’ ইত্যাদি। ইহা গেল আমাদের দেশের প্রবাদের কথা; কিন্তু পশ্চিমা দেশে ‘চোর’দের লইয়া এই ধরনের প্রবাদ কি চালু রহিয়াছে? প্রাত্যহিক জীবনে আমরা খুব বেশি না শুনিলেও আন্তর্জালে তাহার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। জার্মান প্রবাদে আছে—‘সময় হইল চোরের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক। একটা না একটা সময় আসিবেই যখন চোরের স্বরূপ উন্মোচন হইবে।’ জার্মান প্রবাদে আরও বলা হয়—‘যেইখানে হোস্ট নিজেই চোর সেইখানে চুরি আটকানো কঠিন।’ আমেরিকান প্রবাদে বলা হইয়াছে—‘প্রয়োজনীয়তা একজনকে চোর বানাইতে পারে।’ আমেরিকার আরও একটি প্রবাদ আছে—‘চোর ধরিতে বড় চোর লাগে।’ চোর লইয়া জাপানের একটি প্রবাদ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সেইখানে বলা হইয়াছে—‘একজন চোর তাহার চৌর্যবৃত্তি শিখিতে ১০ বছর সময় নেয়।’ ইতালীয় প্রবাদে বলা হয়—‘যখন ভীষণ বিপদ আসে, চোর তখন সৎ হয়।’ অন্যদিকে ডেনিশ প্রবাদে বলা হয়—‘একজন চোর মনে করে প্রত্যেক মানুষই চুরি করে।’

সুতরাং চোরদের ব্যাপারে সমগ্র বিশ্বই অনেক ধরনের কথা বলিয়াছে; কিন্তু ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবাদটি আমাদের দেশে এতটাই প্রচলিত যে, একটি বাচ্চাও তাহা জানে। এমনই একটি বাচ্চা বাবার সহিত চিড়িয়াখানায় গিয়া জিরাফ দেখিয়া বলিল—‘ঐ যে একটি চোরের মা!’ আমাদের চারিপাশেও এমনই অনেক অদৃশ্য ‘জিরাফ’ ঘুরিয়া বেড়ায়।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন