বাংলাদেশের ট্রেড ইউনিয়ন হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন আর্থসামাজিক সংগঠনগুলিতে যেই সকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেইখানে প্রচার-প্রচারণায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করা যাইতেছে। বর্ণাঢ্য লিফলেট, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদির ব্যবহার এবং ভোটারদের সহিত যোগাযোগ রক্ষায় ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপ প্রভৃতি ব্যবহারের কারণে এই ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে। এই পরিবর্তনের পিছনে রহিয়াছে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণসমাজ। আমাদের সমাজের সর্বত্র এই তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বের ছোঁয়া লাগিয়াছে। তাহারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের আসনে নিজেদের জায়গা করিয়া লইতে এখন প্রস্তুত। যদিও রাজনীতির ক্ষেত্রে তাহাদের সাফল্য তুলনামূলক কম, তাহার পরও আমরা মন্ত্রিসভা হইতে শুরু করিয়া স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে ক্রমেই তাহাদের অবস্থান শক্তিশালী হইতে দেখিতেছি। এই পরিস্থিতি দেশ ও দশের জন্য আশাব্যঞ্জকই বটে।
দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ বলিয়াছেন যে, নূতন কিছু করাই তরুণদের ধর্ম। সত্যিই তাহারা নূতনের পূজারি। আমরা অনেক সময় আক্ষেপ করিয়া বলি, মেধাবী তরুণরা রাজনীতিতে আসিতেছেন না। কিন্তু কেন আসিতেছেন না, তাহার কার্যকারণ গভীরভাবে পর্যালোচনা করিয়া দেখি না। মেধাবী তরুণরা ব্যাপকভাবে রাজনীতিতে না আসিলে আমাদের রাজনীতি যে মেধাশূন্য হইয়া পড়িবে, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কার্যকর গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত করিতে হইলে ইতিবাচক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় এই তরুণদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন হইতে শুরু করিয়া জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তাহারাই ছিলেন চালিকাশক্তি। পৃথিবীর বৃহত ও মহত কোনো কাজই তাহাদের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নহে। বর্তমানে বাংলাদেশের উন্নতি ও অগ্রগতির পুরাভাগে রহিয়াছে তরুণদের অংশগ্রহণ। ব্রিটিশ কাউন্সিল, একশনএইড বাংলাদেশ ও ইউনিভার্সিটি অব লেবারেল আর্টস বাংলাদেশের এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়—দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রা লইয়া আমাদের নেক্সট জেনারেশন বা আগামী প্রজন্ম আশাবাদী। বিদেশে উচ্চশিক্ষা, চাকুরি, ভ্রমণ ইত্যাদি কারণেও তাহাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাইয়া গিয়াছে। তাহাদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বর্তমান সময়ের চাইতে আরও বেশি সমৃদ্ধ হইবে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব, বেকারত্ব, দুর্নীতি, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা ও মানহীন শিক্ষা এই ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইতে পারে। তাহারা চান দেশে গণতন্ত্র সমুন্নত হউক, প্রতিষ্ঠিত হউক সমতা ও পরিবেশবান্ধব পরিবেশ। এমন সুন্দর পরিবেশে তাহারা দেশকে নেতৃত্বপ্রদানে আগ্রহী। বর্তমানে ব্যবসা উদ্যোগ ও নাগরিক সম্পৃক্ততায়ও তাহাদের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম। কেননা তাহাদের ৭৫ শতাংশ মনে করেন, এই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ঝুঁকিপূর্ণ। শিক্ষাব্যবস্থায় তাহারা তথ্যপ্রযুক্তির ওপর আরও গুরুত্বারোপের পক্ষপাতী। তাহাদের ৮৭ ভাগ মনে করেন, তাহারা এমন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করিতে চান, তরুণদের লইয়া যাহাদের রহিয়াছে ভালো পরিকল্পনা।
আমরা জানি, তরুণরাই জাতির সবচাইতে উজ্জ্বল, সৃষ্টিশীল ও উদ্যমী শক্তি। তাহারা একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সমগ্র বিশ্বে তরুণদের সংখ্যা আজ ২০০ কোটির বেশি। তাহারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। আবার বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। কর্মক্ষম এই তরুণদের উৎপাদনশীল খাতে যথাযথভাবে কাজে লাগাইতে না পারিলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা লাভ করা সম্ভব হইবে না। এই সম্ভাবনার সদ্ব্যবহারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি যাবতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাহাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিতে হইবে। তাহাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই উৎপাদনশীল শক্তিকে সকল উন্নয়ন পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখিতে হইবে। কিন্তু আমাদের বাস্তব কাজে-কর্মে কি তাহার প্রতিফলন ঘটিতেছে? তরুণরা যেইভাবে বিভিন্ন নেতৃত্বে আগাইয়া আসিতেছেন, তাহা দেখিয়া আমরা খুবই আশান্বিত। কিন্তু আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সম্মুখে রাখিয়া আমরা তাহাদের কথা কতটা ভাবিতেছি, তাহাও একটি বড় প্রশ্ন বইকি।