বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

অর্পিত দায়িত্ব খেয়ানত করা যাইবে না

আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:৫৫

বিজ্ঞানের নিজস্ব সূত্র রহিয়াছে। উহাকে বলা হয় বিজ্ঞানের আইন। ল অব ফিজিকস, ল অব লাইট ইত্যাদি। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নির্দিষ্ট আইন রহিয়াছে। সকল কিছু সুশৃঙ্খল মতো চলিতেছে সেই আইন বা সূত্র অনুযায়ী। সূর্যে হাইড্রোজেন দহন হইয়া হিলিয়ামে পরিবর্তিত হইবার মাধ্যমে যেই আলো ও উত্তাপ তৈরি হয়, উহারও সুনির্দিষ্ট নিয়ম রহিয়াছে। সেই নিয়মের জন্যই সূর্যের সব হাইড্রোজেন একসঙ্গে বিস্ফোরিত হয় না। একইভাবে মানবসভ্যতাও ক্রমশ পরিপূর্ণতা লাভ করিতেছে সুনির্দিষ্ট আইনের বিধান ও তাহার প্রয়োগে মাধ্যমে। ব্রিটানিকার তথ্যানুযায়ী খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিক আইনপ্রণেতা সোলন প্রথম অ্যাথেন্সকে আইনের আওতায় আনিবার পরিকল্পনা করেন। একইভাবে, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে একটি রোমান কমিশন এবং চতুর্থ শতাব্দীতে অ্যারিস্টটল আইনের একটি মডেল সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা করেন। সুতরাং, প্রাচীনকাল হইতেই ‘ন্যায়বিচার’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা আমরা দেখিতে পাই। এই ক্ষেত্রে বলিতেই হয় ইংল্যান্ডের কথা। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস-এর আইনি ব্যবস্থা হাজার বত্সর ধরিয়া ক্রমশ বিকশিত হইয়াছে। অতীতের কিছু কিছু আইনি ব্যবস্থা ছিল বিস্ময়কর। যেমন দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাবধি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য এক ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দিতে হইত। অভিযুক্তকে একটি তপ্ত লোহার পাত হাতে তুলিয়া লইতে হইত অথবা ফুটন্ত জলের কড়াই হইতে একটি পাথর তুলিয়া লইতে হইত। ইহাতে অভিযুক্তের হাতে ক্ষতের সৃষ্টি হইত। যদি তাহার হাতের ক্ষত তিন দিন পর নিরাময় হইতে শুরু করিত, তবে মনে করা হইত ঈশ্বর তাহার পাশে রহিয়াছে। অর্থাত্ অভিযুক্ত নিরাপরাধী। এইভাবে অভিযুক্তকে তাহার নির্দোষতা প্রমাণ করিতে হইত। পরবর্তী সময়ে এই ধরনের অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে বিচার নিষিদ্ধ করা হইয়াছিল। কারণ, কথিত আছে, হরিণ হত্যার জন্য অভিযুক্ত ৫০ জন অপরাধী এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া মুক্তি পাইয়াছিল এবং ১২১৬ সালে এই ধরনের বিচারের নিন্দা শুরু হয়। আরো পরে ইংল্যান্ডে বিচারকরা ধীরে ধীরে রাজা এবং সরকারের নিকট হইতে স্বাধীনতা লাভ করেন। আর এইভাবে ‘সকলের জন্য সমান আইন’ ক্রমশ তত্কালীন ইংল্যান্ডে চালু হয়।

আধুনিক রাষ্ট্র মনে করে, আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটিলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্রের সুনীতি। তবে সমস্যা হইল, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো আধাসামন্তবাদী মানসিকতা দূর হয় নাই। এই সকল বিষয় লইয়া যাহারা গবেষণা করেন, তাহারা মনে করেন, বহু যুগ ধরিয়া উন্নয়নশীল বিশ্বের সমাজ গড়িয়া উঠিয়াছে একধরনের নৈরাজ্যের ভিতর দিয়া। এই জন্য তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে একটি জাতির নিয়মতান্ত্রিক সুষ্ঠু বিকাশধারার জন্য তৈরিকৃত প্রতিষ্ঠানের জন্য যতই বলা হউক—‘উহা নিয়মের মধ্যে চলিবে’—তাহা আসলে বাস্তবে দেখা যায় না। আরেকটি সমস্যা হইল—উন্নয়নশীল বিশ্বে শিক্ষাদীক্ষা হইতে শুরু করিয়া সকল কিছুই সীমিত। ফলে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষেরাও মনে করেন, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা করিতে পারেন না—এমন কোনো কাজ নাই। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, কোথাও যদি আইন বা নিয়মকানুনকে যখন-তখন পাশ কাটানো হয়, অথবা উহার অপব্যবহার করা হয়, তাহা হইলে উহা হইয়া উঠিতে পারে একটি রাষ্ট্রের কল্যাণকর ও আধুনিক হইবার পথের সবচাইতে বড় বাধা। মহাভারতে বলা আছে—‘যদি কোনো ঘটনায় মানুষ ভয়প্রাপ্ত তবে তাহার পরাজয়ই হয়।...নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে কখনো সন্দেহ প্রকাশ করা সঠিক নহে।’ নবিজি (স.) বলিয়াছেন যে, আল্লাহ তাহার কোনো বান্দাকে যদি মানুষের জন্য দায়িত্বশীল হিসাবে নিযুক্ত করেন, অতঃপর সেই ব্যক্তি যদি তাহার উপর অর্পিত দায়িত্ব খেয়ানত করিয়া মৃত্যুবরণ করেন, তাহা হইলে তাহার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করিয়া দেন। সুতরাং জানিতে হইবে নিজেকে, জানিতে হইবে নিজের সীমাবদ্ধতাকেও।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন