পরিবর্তনের স্লোগান লইয়া এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সেনা অভ্যুত্থান সাধারণ ঘটনায় পরিণত হইয়াছে। বিশেষ করিয়া সাম্প্রতিককালে আফ্রিকার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে একের পর এক ঘটিয়াছে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা। রক্তপাত বা বিনা রক্তপাতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিলেও এই সকল দেশের মানুষ নূতন আশা-আকাঙ্ক্ষায় রাজপথে নামিয়া আসে এবং উল্লাস প্রকাশ করেন। নাইজারের পর সর্বশেষ পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গ্যাবনে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়া গেল, সেইখানেও অভ্যুত্থানের নায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ব্রাইস ওলিগুই গিইমাকে কাঁধে লইয়া রাজধানী লিব্রেভিলের রাস্তায় বিজয় মিছিল করা হইয়াছে। গ্যাবন ৫৬ বছর ধরিয়া একটি পারিবারিক রাজবংশের অধীনে ছিল; কিন্তু প্রশ্ন হইল, এই পরিবর্তন কি শেষ পর্যন্ত টিকসই হইবে?
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫০ হইতে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পৃথিবীতে মোট ৪৮৮টি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটিয়াছে। তাহার মধ্যে আফ্রিকাতেই ঘটিয়াছে ২১৬টি। ইহার মধ্যে আবার ১০৮টি অভ্যুত্থান ছিল সফল। গ্যাবন ও নাইজারে একসময় ছিল ফরাসি উপনিবেশ। দরিদ্র হইলেও এই দুইটি দেশ ইউরেনিয়াম, কয়লা ও সোনার মতো দামি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। শুধু এই দুইটি দেশ নহে, গত দুই-তিন বছরের ব্যবধানে আফ্রিকার শাদ, গিনি, মালি, সুদান ও বুরকিনা ফাসোতে ঘটিয়াছে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা। এই সকল দেশের জনগণ দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও অপশাসনে ছিলেন নিষ্পেষিত ও অসন্তুষ্ট। আফ্রিকা মহাদেশে গত এক দশকে মিশর ও জিম্বাবুয়েও সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়াছে। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯০ সাল হইতে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলোতে মোট ২৭ বার সেনা অভ্যুত্থান হইয়াছে, যাহার ৭৮ শতাংশই হইয়াছে সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলিতে।
এইদিকে পাঁচ দশক আগেও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিতে সামরিক শাসন ছিল একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষ করিয়া দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়ায় স্বাধীনতা লাভের পর হইতে প্রায় ২০০ বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়াছে। এখানকার মেক্সিকো হইতে শুরু করিয়া ব্রাজিল পর্যন্ত বেশ কিছু দেশে বেসামরিক শাসন থাকিলেও সেখানে এখনো জেনারেলদের প্রচ্ছন্ন দাপট রহিয়াছে। ইহা ছাড়া এশিয়ায় মিয়ানমার, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সামরিক শাসনের কথা তো বলাই বাহুল্য। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, যেই সকল দেশের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেস্ক (এইচডিআই) তথা মানব উন্নয়ন সূচক খুব কম থাকে, সেই দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা অধিক। মূলত ক্ষুধা, দারিদ্র্য, মূল্যবৃদ্ধি, নৈরাজ্য, দুর্নীতি বা লুটপাটের হাত ধরিয়াই ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান। এই সকল দেশে সামরিক অভ্যুত্থান সফল হয় দুর্বল রাষ্ট্র ও দুর্বল নাগরিক সমাজের কারণে। উপনিবেশবাদ বা নব্য উপনিবেশবাদের কারণে এই সকল দেশে কায়েম হয় লুটপাটের রাজত্ব। লাতিন আমেরিকা সোনা, তামা, কটন ও চিনি সম্পদে সমৃদ্ধ। তাহার পরও এই সকল দেশের নাগরিকরা দরিদ্র ও পশ্চাত্পদ।
উন্নয়নশীল এই সকল দেশে বারংবার পরিবর্তনের কথা বলিয়াই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। ইহার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন যে আসে না তাহা নহে; কিন্তু কিছুদিন না যাইতেই নূতন শাসকরা দুর্নীতির আশ্রয় লইয়া একই কাজ শুরু করেন এবং অর্থ পাচারসহ দেশে সৃষ্টি করেন দুঃসহ পরিস্থিতি। সরকারি দল প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগকে কবজা করিয়া ফেলে। এইভাবে এই সকল দেশে যাহারা ক্ষমতায় থাকেন, শেষপর্যন্ত তাহাদের আরাধনা হইয়া দাঁড়ায়- ‘এলোমেলো করে দে মা লুটেপুটে খাই’। ইহা ছাড়া তাহাদের ক্ষেত্রে এই বাংলা প্রবাদ বাক্যটিও ধ্রুবতারার মতো সত্য হইয়া উঠে—যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবন। এইভাবে পরিবর্তনের ধুয়া তুলিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করিলেও তাহারা দুর্নীতি ও অপশাসনের ক্ষেত্রে অনেক সময় পূর্বশাসনামলকেও ছাড়াইয়া যান। এই চক্রাবর্তে আটকাইয়া রহিয়াছে উন্নয়নশীল বিশ্ব। সত্যিই তাহারা হতভাগ্য ও অসহায়!