একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যে সমস্ত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয় সেইগুলি মূলত দেশের সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্ট, দৈন্য-দুর্দশা লাঘব করিবার জন্য। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সার্বিকভাবে উন্নয়ন খাতে যেই পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী জনগণ কি যথাযথ সুবিধা পাইতেছে? উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের হিসাব করিলে বিকল সরঞ্জামের সংখ্যা গণনা করিয়া শেষ করা যাইবে না। গতকাল ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল বিশেষায়িত হাসপাতাল—বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যালের একমাত্র এমআরআই মেশিন এবং ১০টি এক্সরে মেশিন গত ছয় বছর যাবত বিকল হইয়া পড়িয়া আছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে, উক্ত হাসপাতালের চিকিৎসক হইতে শুরু করিয়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ প্রায় সকলেই স্থানীয় ডায়াগনস্টিক এবং প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবসার সহিত জড়িত। মেশিন নষ্ট বলিয়া এক্সরে, ইসিজি, এমআরআই ইত্যাদি টেস্ট করিবার জন্য রোগীদের সরকারি হাসপাতাল হইতে ভাগাইয়া বাহিরের বেসরকারি ক্লিনিক এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলিতে লইয়া তাহাদের নিকট হইতে মোটা অঙ্কের টাকা হাতাইয়া নেওয়া হয়। কোটি টাকা খরচ করিয়া সাধারণ মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রদান করিবার পরেও জনসাধারণের এই যে ভোগান্তি—তাহা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কারণ এই ধরনের ভোগান্তি যাহাতে না হয়, তাহা দেখিবার জন্য বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা রহিয়াছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির একটি প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, দেশের প্রধান তিনটি হাসপাতালের ১৯ ধরনের যন্ত্রের প্রায় ২৩৮টি চিকিৎসা সরঞ্জাম বিকল হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। এই যন্ত্রগুলির মধ্যে রহিয়াছে এক্সরে, এমআরআই, ইসিজি মেশিন, সিটি স্ক্যান, অটোক্লেভ, ডেন্টাল ডিভাইস, অক্সিজেন জেনারেটর ইত্যাদি।
শুধু চিকিৎসা ক্ষেত্রে নহে, দেশের বিভিন্ন সেবা খাতে ভোগান্তি, অনিয়ম ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার অসংখ্য সংবাদ প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হইতেছে। সাধারণ জনগণ শিকার হইতেছে বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তির। শিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞান সরঞ্জাম, কম্পিউটার, প্রজেক্টর সরকার হইতে প্রদান করা হইয়াছে; কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় এই সকল ডিভাইস কিংবা যন্ত্রপাতি বিকল হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। হয়তো সামান্য মেরামত কিংবা রক্ষণাবেক্ষণ করিলেই এই সকল দামি যন্ত্রপাতি পুনরায় সচল করা যায়; কিন্তু কথায় বলে—সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল। দেখা যায়, যাহারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাহাদের অনেকেই এই ক্ষেত্রে ন্যূনতম দায়িত্বর পরিচয় দেন না। এই দায়িত্বহীনতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী এই সকল উন্নত প্রযুক্তির পঠনপাঠন হইতে বঞ্চিত হইতেছেন। দেশের সার্বিক উন্নয়নের চিত্র তখনই উজ্জ্বল হইবে যখন তাহার নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় লোকবল বা মেরামতির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হইবে।
ইহার জন্য সাধারণ মানুষকেও সচেতন হইতে হইবে। দেশের প্রত্যেক নাগরিক যদি নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে এবং সততার সহিত পালন করেন, তাহা হইলে এই ধরনের নিয়মের বিচ্যুতি কিংবা দায়িত্বহীনতার অপসংস্কৃতি হইতে আমরা ক্রমশ বাহির হইতে পারিব। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট বলিয়াছেন, ‘কোনো কার্য হাসিলের জন্য মানুষের দায়িত্ব পালনের সদিচ্ছা থাকিতে হইবে।’ সুতরাং শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নটাই শেষ কথা নহে, মানুষের নৈতিক উন্নয়নের প্রতিও নজর দিতে হইবে। যে বুদ্ধি ও বিবেকের কারণে আমরা আশরাফুল মাখলুকাত হইয়াছি—তাহার প্রতিফলন আমাদের সমাজ গঠনে ঘটিতেছে কি না—সেই প্রশ্ন নিজেদের করিতে হইবে। দেখিতে হইবে বুদ্ধি ও বিবেকের দর্পণে।